Berger Paint

ঢাকা, শনিবার   ১০ জুন ২০২৩,   জ্যৈষ্ঠ ২৬ ১৪৩০

ব্রেকিং:
চট্টগ্রাম, গাজীপুর, কক্সবাজার, নারায়ানগঞ্জ, পাবনা, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ ব্যুরো / জেলা প্রতিনিধি`র জন্য আগ্রহী প্রার্থীদের আবেদন পাঠানোর আহ্বান করা হচ্ছে। শিক্ষাগত যোগ্যতা- স্নাতক, অভিজ্ঞদের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল যোগ্য। দৈনিক প্রতিদিনের চিত্র পত্রিকার `প্রিন্ট এবং অনলাইন পোর্টাল`-এ প্রতিনিধি নিয়োগ পেতে অথবা `যেকোন বিষয়ে` আর্থিক লেনদেন না করার জন্য আগ্রহী প্রার্থীদের এবং প্রতিনিধিদের অনুরোধ করা হল।
সর্বশেষ:
মেসির অভিষেক ম্যাচের টিকিটের দাম ১০ লাখ টাকা! জেলায় জেলায় বিদ্যুৎ অফিসের সামনে বিএনপির অবস্থান পোশাক কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত, রেশনিং পদ্ধতিতে লোডশেডিংয়ের পরামর্শ ভারতীয় পেঁয়াজ পৌঁছতেই দেশি পেঁয়াজ ৪০ টাকায় বিক্রি দুই মাসে হিট স্ট্রোকে ২০ জনের মৃত্যু: দুর্যোগ ফোরাম এইচএসসি পরীক্ষা শুরু ১৭ আগস্ট, রুটিন প্রকাশ

সামাজিক অনুষ্ঠানে স্থবিরতা, কবে ফিরবে স্বাভাবিক ছন্দ

মো: জিল্লুর রহমান

প্রকাশিত: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০  

মো: জিল্লুর রহমান। ছবি- প্রতিদিনের চিত্র

মো: জিল্লুর রহমান। ছবি- প্রতিদিনের চিত্র


কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই
আজ আর নেই,
কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেলগুলো সেই
আজ আর নেই।----
মান্নাদের গানের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে আগের মতো জৌলুষ ও আনন্দ উল্লাস নেই। করোনা ঝড়ের কবলে পড়ে পুরো বিশ্ব আজ স্থবির। চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাস ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। বিরাজ করছে যুদ্ধ-বিগ্রহ, দুর্ভিক্ষ, বিপ্লব কিংবা বিদ্রোহ কালের চেয়েও নিকৃষ্টতর পরিবেশ। থমকে দাঁড়িয়েছে সবকিছু। সবাই ভীত-বিহ্বল, উদভ্রান্ত। আজ থেকে ছয় মাস আগেও এই নিষ্ঠুর বাস্তবতার কথা মানুষ হয়তো কল্পনাও করতে পারেনি। কিন্তু আজ! প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে বদলে যাচ্ছে চিরচেনা পৃথিবীর চেহারা। যার করাল গ্রাসের প্রভাব পড়ছে আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের নানাবিধ অনুষ্ঠানে। পৃথিবীতে যে মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে এর প্রভাব অনেক গভীরে। এজন্য সভ্যতার গতি শুধু থেমেই যাবে না বরং পিছিয়ে দেবে কয়েক দশক। এর সাথে সংশ্লিষ্ট  অনেকের জীবনের চাকা সম্পূর্ণভাবে বদলে গেছে।

 

করোনা নিয়ন্ত্রণে কঠোর ‘লকডাউন’ এখন আর নেই। তবে বিয়ের অনুষ্ঠানসহ সামাজিক অনুষ্ঠান স্থবির হয়ে আছে। আগস্ট মাসের মধ্যভাগ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে শুরু হয়েছে সীমিত আকারের সামাজিক অনুষ্ঠানাদি। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোন আনুষ্ঠানিকতা দৃশ্যমান নয়। ঘরোয়াভাবে সাদামাটা বিয়ের পাড়ি দিচ্ছেন অনেক বর-কনের অভিভাবকরা। কয়েক শর্তে কমিউনিটি সেন্টার খুলে দেয়া হয়েছে। তারপরও বিয়ে অনুষ্ঠান নিয়ে দোদূল্যমানতায় ভুগছে অভিভাবকরা। শুধু বিয়ে-শাদি নয়, জন্মদিন, কুলখানি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পিকনিক, আনন্দভ্রমন, মিলাদ মাহফিল, রাজনৈতিক সমাবেশ সবকিছুতেই শুনশান নীরবতা। নেই কোন বাড়তি উত্তেজনা ও আনন্দ উল্লাসের লেশমাত্র। চারদিকে শুধুই অজানা এক শঙ্কা, সন্দেহ ও ভীতিকর পরিবেশ।

 

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের প্রধান সামাজিক অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে মুসলমান সম্প্রদায়ের উৎসব ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা ও ঈদে মিলাদুন্নবী। হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গা পূজা, বৌদ্ধদের বুদ্ধ পূর্ণিমা, আর খ্রিস্টানদের বড়দিনও ঘটা করে পালিত হয়ে থাকে স্ব স্ব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে। এই দিবসগুলোতে রাষ্ট্রীয় ছুটি থাকে। সার্বজনীন উৎসবের মধ্যে পহেলা বৈশাখ প্রধান। গ্রামাঞ্চলে নবান্ন, পৌষ পার্বণ ইত্যাদি লোকজ উৎসবের প্রচলন রয়েছে। এছাড়া স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস এবং ভাষা আন্দোলনের স্মরণে একুশে ফেব্রুয়ারি সাড়ম্বরে পালিত হয়। কিন্তু এ বছর করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে প্রত্যেকটি উৎসব নামমাত্র উদযাপন করা হয়েছে। নেই কোন আনন্দ উল্লাস, নেই কোন প্রাণের মেলবন্ধনের ছোঁয়া!

 

এদিকে বিয়ের মতো নানা সামাজিক আয়োজন ও অনুষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থনৈতিক দৈন্যদশা এখন চরমে। তারাও চাইছে বিয়ের মতো সামাজিক অনুষ্ঠান শুরু হোক। নানা সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান না হওয়ায় রেন্ট এ কার থেকে কোন গাড়ি ভাড়া যায় না। বিয়ের অনুষ্ঠানে দরকার হয় হলুদের ডালা, গায়ে হলুদ, বউ ভাত, চালুন কুলা, বরের গাড়ির চারদিকে ফুল দিয়ে সাজানো, বাসর ঘরে নববধূ ও বরের খাট সম্পূর্ণ ফুল দিয়ে সাজানো ইত্যাদি কিন্তু সব কিছুতেই স্থবিরতা। বিয়ে সামগ্রীর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়িদের দিনকাল অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের সাথে সংশ্লিষ্টদের নেই কোন হাঁকডাক ও বাড়তি চাহিদা।

 

কমিউনিটি সেন্টার কর্তৃপক্ষের মতে, স্বাস্থ্যবিধি এবং সামজিক দূরত্ব মেনে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ ডিসকাউন্ট দিয়েও বিয়ের মতো কোন সামাজিক অনুষ্ঠান হচ্ছে না। কেউ কেউ মাঝে মধ্যে খোঁজ খবর নিতে আসে, তবে কোন কারণে শেষ পর্যন্ত তারা পিছুটান দেন। সামাজিক অনুষ্ঠানের সাথে জড়িত বাবুর্চীদের দিনকাল অত্যন্ত খারাপ যাচ্ছে। বিয়ে-শাদি, জন্মদিন, কুলখানি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পিকনিক, আনন্দভ্রমন, মিলাদ মাহফিল, রাজনৈতিক সমাবেশ সবকিছুতেই বাবুর্চীদের একটা আলাদা কদর থাকে। নামকরা বাবুর্চীদের শিডিউল পাওয়া যেখানে বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল, সেখানে এখন বাবুর্চীদের মতো অনেকেই নিষ্কর্ম বসে আছে। নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছে তারা। তাছাড়া, যারা ডেকোরেটর বা ক্যাটারিং সার্ভিস ব্যবসার সাথে জড়িত, তারাও বেশ কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করছে।

 

করোনার কারণে কোন অভিভাবক বিয়ের ঝুঁকি নিতে চাইছে না। তবে আগস্টের মধ্যভাগে কিছুটা পরিবর্তন আসে। কিছুদিন আগে অনলাইনে বিয়ের উদ্যোগ নেয়া হলেও তাতে বিয়ে নিবন্ধনকারী কাজীগণ আপত্তি তোলেন। বিয়ে অনুষ্ঠানে ভাটা পড়ায় কাজীদের দিনকালও ভাল যাচ্ছে না। তারা সরকারী কোন আর্থিক সহায়তা ও সুবিধা সরাসরি পান না। প্রত্যেক কাজীকে বছরে সাড়ে ১৬ হাজার টাকা নিবন্ধন ফি জমা দিতে হয় সরকারী কোষাগারে। তারা বিয়ের নিবন্ধনে চার লাখ টাকা পর্যন্ত দেনমোহরানা ধার্য হলে প্রতি হাজারে সাড়ে ১২ টাকা করে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা ফিস (কমিশন) পান। চার লাখের ওপরে প্রতি লাখে এক শ’ টাকা হারে ফিস পান। কাজিদের মতে, বিয়ের দেন মোহরে চার লাখ টাকা খুব কমজনই ধার্য করেন। এর ওপরে দেন মোহরানা ধার্য করেন বিত্তশালী পরিবার। হিন্দু ধর্মাবলম্বীগণের বিয়েতে নির্দিষ্ট কোন ফিস নেই। মন্দিরে পুরোহিতগণ বর ও কনের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন। হিন্দুদের বিয়ের অনুষ্ঠানেও ভাটা পড়েছে। বর্তমানে মুসলিম ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিয়েতে কার্ডের মাধ্যমে নিমন্ত্রণের প্রথা এখন খুব কম। সবই এখন ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তারপরও কার্ডের দোকানগুলোতে অল্প হলেও কার্ড ছাপানো হতো। করোনাকালে কার্ড বিক্রিও একেবারেই নেই। ঘটকালির বিয়েতে ঘটকদের বাজারও বেশ মন্দা।

 

সামাজিক জীব হিসেবে মানুষে মানুষে যে কাছে আসা কাঙ্ক্ষিত, করোনাকালে দেখা যাচ্ছে সেই কাছে আসা নিয়েই যত ভয় ও শঙ্কা! কারণ, করোনা মানুষ থেকে মানুষেই সংক্রমিত হয়। ফলে পরস্পরের শারীরিক দূরত্ব জরুরি। সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি অনুসারে সঙ্গত কারণেই সকলকে সামাজিক বা শারিরীক দূরত্ব বজায় রাখতে হয়। এ থেকে পরস্পরকে ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রাখার অভ্যাস গড়ে গড়ে তুলতে হচ্ছে। ফলস্বরুপ, সামাজিক জীবনযাপনের নতুন অনুষঙ্গ হতে যাচ্ছে 'সামাজিক দূরত্ব' বা 'পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা'। এ থেকে আমাদের মনের ভেতরে গেঁথে গেছে এক অজানা আতংক। ইদানিং অনেকেই বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, সভা-সমাবেশ, শপিংমলে যাওয়া এমনকি গণপরিবহনে চড়াও কমিয়ে দিচ্ছে।  

 

আগস্ট মাসে সীমিত পরিসরে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় মাত্র চার শতাংশ বিয়ে হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। ঘরোয়া পরিবেশে ধর্মীয় রীতি মেনে নিবন্ধনের প্রয়োজনীয় কাজটি অনেকে সেরেছেন। বিয়ে অনুষ্ঠানে আড়ম্বর তো দূরে থাক, অনাড়ম্বর পরিবেশও ছিল না। যেসব পরিবারের সন্তানদের বিয়ের কথাবার্তা চালাচালি হচ্ছে তারাও দিনক্ষণ ঠিক করতে পারছে না। পাকা কথা হয়ে আছে এমন অনেক পরিবারের ভাষ্য, নভেম্বরের মধ্যভাগের পর থেকে ডিসেম্বরের শেষ ভাগের মধ্যে সাধারণত হবু বর হবু কনের পরিবারের সম্মতিতে তারিখ নির্ধারণ করা হয়। কারণ এই সময়টায় আবহাওয়ায় নাতিশীতোষ্ণ থাকে, যা বিয়ের জন্য উপযুক্ত সময়। আসলে বিয়ে অনুষ্ঠান তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। খরচ আছে। উভয়পক্ষের পরিবারের আনুষঙ্গিক খরচের হিসাব আছে। আপ্যায়নের বিষয় আছে। কেনাকাটা আছে। কমিউনিটি সেন্টারে খোলা থাকলে কত মানুষের আয়োজন করা যাবে সামাজিক দূরত্ব কতটা মেনে চলা যাবে এসব নানা প্রশ্নের জট পাকছে। চাকুরীর মতো বর কনের বিয়েতেও জট পাকছে।

 

কাজীদের ভাষ্য, সেশন জট যানজটের মতো বিয়েতেও বিয়েজটও লেগেছে। যেন স্থবির অবস্থা। করোনা ভাইরাসের কারণে সব লন্ডভন্ড। কোন কিছুতেই যেন গতি আসছে না। সকলের মনেই এক অজানা শঙ্কা, কখন শেষ হবে এ মহামারীর তান্ডব, নবরূপে ফিরবে জীবনের স্বাভাবিক সাধ ও ছন্দ।

 

লেখক: ব্যাংকার ও কলাম লেখক, সতিশ সরকার রোড, গেন্ডারিয়া, ঢাকা।

এই বিভাগের আরো খবর