Berger Paint

ঢাকা, শুক্রবার   ০২ জুন ২০২৩,   জ্যৈষ্ঠ ১৯ ১৪৩০

ব্রেকিং:
চট্টগ্রাম, গাজীপুর, কক্সবাজার, নারায়ানগঞ্জ, পাবনা, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ ব্যুরো / জেলা প্রতিনিধি`র জন্য আগ্রহী প্রার্থীদের আবেদন পাঠানোর আহ্বান করা হচ্ছে। শিক্ষাগত যোগ্যতা- স্নাতক, অভিজ্ঞদের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল যোগ্য। দৈনিক প্রতিদিনের চিত্র পত্রিকার `প্রিন্ট এবং অনলাইন পোর্টাল`-এ প্রতিনিধি নিয়োগ পেতে অথবা `যেকোন বিষয়ে` আর্থিক লেনদেন না করার জন্য আগ্রহী প্রার্থীদের এবং প্রতিনিধিদের অনুরোধ করা হল।
সর্বশেষ:
রাজধানীতে বাড়ির উঠানে পুঁতে রাখা কানাডা প্রবাসী নারীর মরদেহ উদ্ধার পে-স্কেল না হলেও সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এরদোয়ানের ফোন বিএনপি নেতা খায়রুল কবিরের বাড়িতে আগুন নাইজেরিয়ার কাছে হেরে বিদায় স্বাগতিক আর্জেন্টিনার বিদ্যুতের ঘাটতি ৩০০০ মেগাওয়াট, সারা দেশে লোডশেডিং

পঁচাত্তর পেরিয়ে আজও রঙীন শর্মিলা ঠাকুর!

শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, কোলকাতা

প্রকাশিত: ১০ ডিসেম্বর ২০১৯  

তাঁর প্রথম ছবির নায়ক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় শর্মিলার সৌন্দর্য্য নিয়ে বলেছেন "আমার অভিনয় জীবনে এত নায়িকার সঙ্গে কাজ করেছি, রিঙ্কু একমাত্র নায়িকা যে বয়সোচিত সাজে শরীর মন সবুজ রেখে স্নিগ্ধ সুন্দরী, ন্যাচারাল বিউটি। যে নিজেকে সেই 'অপুর সংসার' থেকে অবিরত মেনন্টেন করে চলেছে।"
শর্মিলা ঠাকুর মানেই দু গালে টোল যা চিরকালীন আইকনিক।
কোন মানুষ যখন নিজেকে যুগ যুগান্তর সুন্দর রাখেন – এর পিছনে লুকিয়ে থাকে কোনো এক গল্প, নিত্যদিনের অধ্যাবসায়, শিক্ষা, চর্চা, পরিমিতিবোধ।
কি এমন সেই ঘটনা যা শর্মিলা ঠাকুর-কে তাঁর জীবন সুসজ্জিত করতে বাধ্য করেছিল। যে ঘটনা আজীবন মনে রেখে শর্মিলা তাঁর জীবন দর্শন পাল্টে ফেললেন?

তাহলে টাইম মেশিনে করে চলে যেতে হবে আরও অনেক বছর পিছিয়ে।
শর্মিলার প্রকৃত পদবী যেহেতু ঠাকুর তাই তিনি যে রবি ঠাকুরর উত্তরসূরী, এ তো জানা।
শর্মিলা ঠাকুর কিন্তু বাবা মা দু’দিক দিয়েই ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে জড়িত। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সন্তান দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতনি ছিলেন লতিকা ঠাকুর। লতিকা বিয়ে করেন অসমের জ্ঞানদাভিরাম বড়ুয়াকে। জ্ঞানদাভিরাম ছিলেন গুয়াহাটির আর্ল ল’ কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ।
জ্ঞানদাভিরাম এবং লতিকার কন্যা হলেন ইরা। তাঁর আবার বিয়ে হল মামাবাড়ির দিকে জ্ঞাতি পরিবারে। ইরার স্বামী হলেন গীতিন্দ্রনাথ ঠাকুর।
এই গীতিন্দ্রনাথ ঠাকুর সমন্ধে এবার আসুন জানি। নাহ না গুলিয়ে যাবেনা। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ভাই ছিলেন গিরীন্দ্রনাথ।
গিরীন্দ্রনাথের সন্তান গুণেন্দ্রনাথ। গুণেন্দ্রনাথের ছেলে গগনেন্দ্রনাথ ( বিখ্যাত গগন ঠাকুর নামেও )। গগনেন্দ্রনাথের পুত্র কনকেন্দ্রনাথ। কনকেন্দ্রনাথের সন্তান হলেন গীতিন্দ্রনাথ।

অর্থাৎ দাদুর বাবার ভাইয়ের নাতির নাতিকে বিয়ে করেছিলেন লতিকা ঠাকুর কন্যা ইরা। গীতিন্দ্রনাথ-ইরার মেয়ে হলেন শর্মিলা।
তার মানে দাঁড়াল‚ শর্মিলা ঠাকুর হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদার মেয়ের নাতনি।
উফ, আজকাল অনু পরিবার কেন্দ্রিক সমাজে এই পরিবার বৃক্ষের শাখা প্রশাখা বোঝা খুব জটিল তবু আমাদের গল্প বলতে দরকার।
আসি আমাদের মূল গল্পে, কি এমন ঘটনা যা পাল্টে দেয় শর্মিলা ঠাকুরের জীবন দর্শন?
তখন রিঙ্কু ওরফে শর্মিলা ছোট্ট মেয়ে স্কুলে পড়ে। ছোটো রিঙ্কুকে তাঁর মা রবি ঠাকুরের ‘গোরা’ বইটি উপহার দেন এবং বলেন ‘দেখো রিঙ্কু এই বই একটা দুর্লভ সম্পদ যার দায়িত্ব আমি তোমায় দিলাম।এই বই তুমি আরও পাবে কিন্তু আমি যা দিলাম সেটা কোথাও পাবেনা।কারন এই বইতে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সই করে দিয়েছেন।রবি ঠাকুরের নিজের হাতে লেখা সই দেখো রয়েছে এই বইতে।’
শর্মিলা তো এমন মহারত্ন পেয়ে আনন্দে আত্মহারা। তখন শর্মিলা খুব অগোছালো ছিলেন সবসময় খামখেয়ালী ভাবেই ঘুরে বেড়াতেন। ছোটো মেয়ে এত দায়িত্বশীল না হওয়াই স্বাভাবিক। শর্মিলা সেই বই নিয়ে স্কুলে সহপাঠিনীদের দেখাতে গেলেন যে তাঁর কাছে রবি ঠাকুরের সই করা বই আছে।

সারা ক্লাসকে দেখানো হয়ে গেল রিঙ্কুর। কিন্তু কিছু সময় বাদেই তার টনক নড়ল দেখলো ব্যাগ থেকে বই উধাও। কোনোভাবেই সেই যখের ধন খুঁজে পেলনা রিঙ্কু। বাড়ি ফিরল কাঁচুমাচু মুখ করে।

শর্মিলার মা তো প্রচন্ড রেগে গেলেন। তিনি তাঁর মেয়েকে বারংবার বলে দিয়েছিলেন বইটা অতি সাবধানে যত্ন করে রাখতে আর মেয়ে সেই দায়িত্বটা পালন করলনা। ওমন দুস্প্রাপ্য বই যাতে রবি ঠাকুরের নিজ হাতে সই আছে মেয়ে সেটা হারিয়ে এল। যে বইটার সঙ্গে অনেক আবেগ অনুভূতি পারিবারিক স্মৃতি জড়িয়ে।

শর্মিলার মা ইরা দেবী মেয়ের দায়িত্বহীনতায় এতটাই আঘাত পান যে শর্মিলার সঙ্গে ছয় মাস কথা বলা বন্ধ রেখেছিলেন।

মারধোর বকাবকি কিছু করেননি কিন্তু কঠোর মৌনতায় মেয়েকে জীবনে দায়িত্ববোধ নিতে হয় বুঝিয়ে দেন মা ইরা দেবী। এটি খুব শেখার জিনিস, আজকালকার মায়েরা আগেই গায়ে হাত তুলে দেন সন্তানদের যাতে সন্তানরা আরও হিংস্র জেদী হয়ে ওঠে।কিন্তু কঠোর মৌনতা অনেক শিক্ষা দিয়ে দেয়।

সেই থেকে মূল্যবান জিনিস হারানোর যে কষ্ট অনুভব করেছিলেন শর্মিলা আর কখনও জীবনে চলার পথে এতটুকু অসতর্ক হননি। নিজের ক্যারিয়ার সংসার সন্তান সমগ্র জীবনে সব প্রতিবন্ধকতা উত্তরণ করে নিজেকে এত সুন্দর করে রাখেন সবদিকদিয়ে সেই শিশুবেলায় পাওয়া শিক্ষা থেকে।

সুন্দর এর বিপরীত চরিত্র করেছিলেন শর্মিলা ক্যারিয়ারের শুরুতেই 'ছায়াসূর্য' ছায়াছবির কালো মেয়ে ঘেঁটু। যাকে বাড়ির লোক রক্ষেকালী বলে ডাকত। শর্মিলা ঠাকুর এর দ্বিতীয় ছবি তখন বয়স ১৯...  পরিচালক পার্থ প্রতীম চৌধুরি র প্রথম ছবি ২৪ বছর বয়সে ১৯৬৩ সালে। পরিচালক কে কজন আর মনে রেখেছেন! কিন্তু শর্মিলা তাঁর প্রথম ছবি অপুর সংসার সহ সব অভিনীত ছবির সেরা পাঁচে এই 'ছায়াসূর্য' র ঘেঁটুকে আজও রাখেন। পার্থপ্রতিমের এই ছবি দেখে স্বয়ং সত্যজিৎ রায় চমকে গেছিলেন। পার্থপ্রতিম গুরু মানতেন সত্যজিৎকে, তাই সত্যজিৎ সৃষ্ট নায়িকাকে আরো একধাপ এগিয়ে দেন পার্থপ্রতিম। 
কিন্তু রিঙ্কু শর্মিলা সত্যজিত নায়িকাতেই 'সীমাবদ্ধ' থাকেননি। শর্মিলা একমাত্র সেই নায়িকা যে ধর্ম বর্ণ মিথ ভেঙেছেন কিন্তু আভিজাত্য না ভেঙে। ভারতীয় চলচ্চিত্রে প্রথম বিকিনি পরিহিতা নায়িকা তিনি। ঠাকুরবাড়ির মেয়ে হয়ে এই সাহসিকতার পরিচয় দেন বলিউডে।

শক্তি সামন্তর 'অ্যান ইভিনিং ইন প্যারিস' ছবিতে শর্মিলা বিকিনি পরে সমুদ্রের উপরে স্কি করেছিলেন। কিন্তু বিকিয়ে পড়লেও নিজেকে বিকিয়ে দেননি কখনও। 

এরপর আরেক মিথ ভাঙলেন মুসলিম বিবাহ করে। যা নিয়ে তখন তোলপাড় ভারত। ষাটের দশকে শর্মিলা ঠাকুর- নবাব মনসুর আলী খান পতৌদি শুরু করেছিলেন ভালোবাসার অনবদ্য ইনিংস। মুসলিম পরিবারের নবাব আর হিন্দু পরিবারের বাঙালি কন্যা গাঁটছড়া বাঁধলেন। 
প্রেম আরো জোরালো হয় বিকিনি পরিহিতা ঠাকুরবাড়ির মেয়ে তীব্র সমালোচনার শিকার হন। তখন শর্মিলাকে সাহস জুগিয়েছিলেন টাইগার পতৌদি। বেগম আয়েশা সুলতানা নাম পরিবর্তন করে ধর্মান্তরিত করে নবাব ঘরণী হলেন শর্মিলা। কিন্তু উর্দূ ,চোস্ত ইংরাজি শিখলেন বলে বাংলা ভুলে যাননি। তবে মা হিসেবে মায়ের মাতৃভাষা বাংলা ছেলেমেয়েদের একবর্ণ শেখাতে পারেননি তিনি।
হয়তো পরিবেশ পরিবার কারন। কিন্তু বাংলা প্রীতিতে নবাব পরিবারের খাদ পড়েনি। 
শর্মিলা একের পর এক মিথ ভাঙলেও সেটা নিয়ে নিজে ফলাও করে আমায় দেখো ব্যবহার কোনদিন করেননি। এই পরিমিতিবোধ তাঁর থেকে শিক্ষনীয়।


রাজেশ খান্না,উত্তম কুমার,সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শাম্মী কাপুর,শশী কাপুর,বিগ বি থেকে রঞ্জিত মল্লিক মিঠুন সবার নায়িকা হিসেবে তিনি আদর্শ। শর্মিলাই একমাত্র নায়িকা যিনি যুগের পর যুগ নায়কদের নায়িকা হয়েছেন। 
সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ফিল্ম সার্টিফিকেশন চিফ হয়ে কি দৃঢ়তার সঙ্গে শর্মিলা তাঁর কাজের নজির রাখেন। 
পঁচাত্তর বছরের জন্মদিন কাটালেন মেয়ে জামাই নাতনির সঙ্গে। নাতনিকে কোলে নিয়ে দিদা শর্মিলা জন্মদিন সেলিব্রেট করলেন। 


পঁচাত্তরটি বসন্ত পেরিয়ে,
চিরবসন্তে রঙীন থাকুন রিঙ্কুদি। ভালোবাসা।
লেখক
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়  
কোলকাতা

এই বিভাগের আরো খবর