Berger Paint

ঢাকা, শুক্রবার   ০২ জুন ২০২৩,   জ্যৈষ্ঠ ১৯ ১৪৩০

ব্রেকিং:
চট্টগ্রাম, গাজীপুর, কক্সবাজার, নারায়ানগঞ্জ, পাবনা, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ ব্যুরো / জেলা প্রতিনিধি`র জন্য আগ্রহী প্রার্থীদের আবেদন পাঠানোর আহ্বান করা হচ্ছে। শিক্ষাগত যোগ্যতা- স্নাতক, অভিজ্ঞদের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল যোগ্য। দৈনিক প্রতিদিনের চিত্র পত্রিকার `প্রিন্ট এবং অনলাইন পোর্টাল`-এ প্রতিনিধি নিয়োগ পেতে অথবা `যেকোন বিষয়ে` আর্থিক লেনদেন না করার জন্য আগ্রহী প্রার্থীদের এবং প্রতিনিধিদের অনুরোধ করা হল।
সর্বশেষ:
রাজধানীতে বাড়ির উঠানে পুঁতে রাখা কানাডা প্রবাসী নারীর মরদেহ উদ্ধার পে-স্কেল না হলেও সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এরদোয়ানের ফোন বিএনপি নেতা খায়রুল কবিরের বাড়িতে আগুন নাইজেরিয়ার কাছে হেরে বিদায় স্বাগতিক আর্জেন্টিনার বিদ্যুতের ঘাটতি ৩০০০ মেগাওয়াট, সারা দেশে লোডশেডিং

বহুমুখী প্রতিভাময়ী কুসুম কুমারী দাশ

রহিমা আক্তার মৌ

প্রকাশিত: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৯  

কবি কুসুম কুমারী দাশ

কবি কুসুম কুমারী দাশ

"আদর্শ ছেলে"
কুসুম কুমারী দাশ

আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?
মুখে হাসি বুকে বল, তেজে ভরা মন
‘মানুষ হইতে হবে’ – এই যার পণ৷
বিপদ আসিলে কাছে হও আগুয়ান
নাই কি শরীরে তব রক্ত, মাংস, প্রাণ?
হাত পা সবারই আছে, মিছে কেন ভয়?
চেতনা রয়েছে যার, সে কি পড়ে রয়?
সে ছেলে কে চায় বল, কথায় কথায়
আসে যার চোখেজল, মাথা ঘুরে যায়?
মনে প্রাণে খাট সবে, শক্তি কর দান,
তোমরা ‘মানুষ’ হলে দেশের কল্যাণ৷

বিখ্যাত এই কবিতার কবি কুসুম কুমারী দাশ ১২৮২ বঙ্গাব্দের ২১ শে পৌষ বাখরগঞ্জ জেলার বরিশাল শহরের "গৈলা" গ্রামের এক বিদ্যানুরাগী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা চন্দ্রনাথ দাস এবং মাতা ধনমণি। কলকাতায় ব্রাহ্মসমাজটি গঠিত হয় উনিশ শতকের গোড়ার দিকে । হিন্দু ধর্মের প্রতি ইউরোপীয় মিশনারিদের সমালোচনার প্রতিক্রিয়া হিসেবেই রাজা রামমোহন রায়ের অনুপ্রেরণায় বহু ঈশ্বরবাদী ধ্যানধারণা পরিত্যাগ করে ব্রাহ্মরা উপনিষদের নিরাকার ঈশ্বরে ভজনা করতে থাকে। যদিও ব্রাহ্মদের অনেক আচার খ্রিষ্টধর্মের মতোই ছিল, এবং ব্রাহ্মদের অনেক আচার আবার হিন্দু ধর্মগ্রন্থ সমর্থিত ছিল। ব্রাহ্মধর্মটি ছিল মূলত উনিশ শতকের একটি ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলন। কুসুম কুমারী দাশের বাবা চন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত হয়ে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করায় গ্রামবাসীদের সাথে বিরোধিতার সৃষ্টি হয়, বাধ্য হয়ে "গৈলা" গ্রামের পৈতৃক ভিটা ছেড়ে পরিবার সহ তাকে বরিশালে চলে আসতে হয়। কবি এমনই এক ব্রাহ্ম পরিবারের মেয়ে ছিলেন।

কুসুমকুমারী দাশ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি তিনি খুব বেশি লেখালেখি করতে পারেননি। কিন্তু যেটুকু রেখে গেছেন তাতে তার প্রতিভার ছাপ সুস্পষ্ট। তাঁর রচিত "আদর্শ ছেলে", যার প্রথম চরণ "আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে", বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সর্বাধিক পরিচিত। ছোটবেলা থেকেই একটি পারিবারিক পরিমণ্ডল পেয়েছিলেন তিনি। বরিশাল ব্রাহ্মসমাজ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের হাই স্কুলে তিনি ৪র্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়েন। এরপর বালিকাদের অভাবের জন্য স্কুলটি বন্ধ হয়ে গেলে কুসুমকুমারীকে তাঁর বাবা কলকাতায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের গৃহে রেখে বেথুন স্কুলে ভর্তি করেন। একবছর পর ব্রাহ্মবালিকা বোর্ডিং-এ লাবণ্যপ্রভা বসুর তত্ত্বাবধানে পড়াশোনা করেন। প্রবেশিকা শ্রেণীতে পড়ার সময়েই ১৮৯৪ সালে বরিশালের ব্রজমোহন ইনস্টিটিউশন-এর প্রধান শিক্ষক সত্যানন্দ দাসের সাথে কুসুমকুমারী দাশ এর বিয়ে হয়।

কবি কুসুমকুমারী কলকাতা বেথুন স্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। ১৯ বছর বয়সে পতিগৃহে এসে তিনি জ্ঞানচর্চার একটি প্রশস্ত ক্ষেত্র পেয়েছিলেন। স্বামী সত্যানন্দ দাসের অনুপ্রেরণায় কুসুমকুমারী সাহিত্য চর্চা চালিয়ে যান। এখানে শিশুদের জন্য ‘কবিতা-মুকুল’ পুস্তক রচনা করেন। ‘প্রবাসী’ , ‘ব্রাহ্মবাদী’, ‘মুকুল’ প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রায়ই প্রকাশিত হত। এ ছাড়া তাঁর স্বদেশি যুগের কবিতা, দেশ বিভাগের ফলে আর্ত জনগণের দুর্দশার কাহিনি সংবলিত কবিতা, সাময়িক ঘটনা অবলম্বনে ও মনীষীগণের উদ্দেশ্যে লিখিত কবিতাও উল্লেখযোগ্য। কুসুমকুমারী দাশ শুধু যে একজন কবি ছিলেন তা নয়। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। নিপুণভাবে গৃহকর্ম সম্পন্ন করার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সমাজ কল্যাণমূলক কাজ করতেন। বহু বছর তিনি বরিশাল ব্রাহ্মিকা সমাজের আর্চাযের কাজ করেছেন। বরিশালের বহুবিধ সমাজ সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ব্রাহ্ম সমাজের মহিলা সদস্যও ছিলেন তিনি। কুসুমকুমারী বরিশাল অঞ্চলের বিভিন্ন মহিলাকে স্বাবলম্বী হতে এবং মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে শিখিয়েছেন।

দুই পুত্র এক কন্যা সন্তানের জননী ছিলেন তিনি। জ্যেষ্ঠ পুত্র কবি জীবনানন্দ দাশ। আরেক পুত্র অশোকানন্দ দাশ এবং কন্যা সুচরিতা দাশ। কুসুমকুমারী দাশ এর বাবা চন্দ্রনাথ দাশ কবিতা লিখতেন। জন্মসূত্রেই লেখার ক্ষমতা পেয়েছিলেন কুসুমকুমারী দাশ। তেমনি পেয়েছিলেন তার সুযোগ্য পুত্র জীবনানন্দ দাশ। কবি জীবনানন্দ দাশ মা কুসুমকুমারী দাশ সম্পর্কে লিখেছেন-

"সাহিত্য পড়ায় ও আলোচনায় মাকে বিশেষ অংশগ্রহণ করতে দেখেছি। দেশি বিদেশি কোনো কোনো কবি ও ঔপন্যাসিকের কোথায় কি ভাল, কি বিশেষ তাঁরা দিয়ে গেছেন।এ সবের প্রায় প্রথম পাঠ তাঁর কাছ থেকে নিয়েছি। তাঁর স্বাভাবিক কবি মনকে তিনি শিক্ষিত ও স্বতন্ত্র করে তোলবার অবসর পেয়েছিলেন। কিন্তু বেশি কিছু লিখবার সুযোগ পেলেন না। ...তখনকার দিনের সেই অসচ্ছল সংসারের একজন স্ত্রীলোকের পক্ষে শেষ পর্যন্ত সম্ভব হল না।"

বরিশালের ব্রাহ্মসমাজের সভা-উৎসব-অনুষ্ঠানে কুসুমকুমারী যোগদান করতেন। তিনি ১৩১৯ থেকে ১৩৩৮ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত প্রায় প্রতি বছরই, বরিশাল ছাত্র সংঘের সপ্তাহকালব্যাপী মাঘোত্সবের মহিলা দিবসের উপাসনায় আচার্যের কাজ করেছেন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এমন একটি স্বাভাবিক মর্যাদার অধিকারিণী হয়েছিলেন তিনি যে, শুধু মহিলাদের উৎসবে নয়, ব্রাহ্মসমাজের সাধারণ সভাতেও তিনি আচার্যের কর্মভার কাজ করেছেন। বরিশাল মহিলা সভার সম্পাদক ছিলেন তিনি।

ছোটবেলা থেকেই কবিতা ও প্রবন্ধ লিখতেন কুসুমকুমারী। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, শিশুদের জন্য যে চিত্রশোভিত বর্ণশিক্ষার বই লিখেছিলেন, তার প্রথম ভাগে কুসুমকুমারী রচিত যুক্তাক্ষরবিহীন ছোট ছোট পদ্যাংশ ছিল। তিনি সম্পাদক মনোমোহন চক্রবর্তীর অনুরোধে লিখেছেন "ব্রহ্মবাদী" পত্রিকায়। তাঁর অল্প কিছু কবিতা প্রকাশিত হয়েছে "প্রবাসী" ও "মুকুল" পত্রিকায়। তিনি নিয়মিত পত্রিকা রাখতেন।

কুসুমকুমারী দাশ বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেন। কবিতা, প্রবন্ধ এবং দৈনন্দিন দিনলিপি। এসব লেখায় তার মুন্সিয়ানা সহজেই চোখে পড়ে। তাঁর কবিতায় বার বার এসেছে ধর্ম, নীতিবোধ, দেশাত্মবোধের কথা। কাব্যগ্রন্থ "কাব্য মুকুল" গদ্যগ্রন্থও "পৌরানিক আখ্যায়িকা" তিনি রচনা করেন। "দৈনন্দিন দিনলিপি'' নামে তাঁর একটি ডায়রীও প্রকাশিত হয়েছে। "নারীত্বের আদর্শ" নামে এক প্রবন্ধ প্রতিযোগীতায় কুসুমকুমারী স্বর্ণ পদকে ভূষিত হন। ১৯৪৮ খ্রীষ্টাব্দের ২৫ ডিসেম্বর কলকাতার রাসবিহারী এভিনিউ এর বাড়িতে তাঁর মৃত্যু হয়।


লেখক- সাহিত্যিক কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক।

এই বিভাগের আরো খবর