ভজাল ও নিম্নমানের ওষুধ জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি
০৯ আগস্ট ২০১৮, ০২:২১ পিএম

মানুষের মৌলিক অধিকারের একটি হচ্ছে চিকিৎসা। আর এক্ষেত্রে প্রাণ হচ্ছে ওষুধপত্র। কিন্তু ভেজাল, নিম্নমানের, মেয়াদোর্ত্তীর্ণ ওষুধে সয়লাব দেশ। আর ভেজাল ওষুধে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে গ্রামের মানুষ। গ্রামের মানুষ সচেতনার অভাবের কারণেই এ দুর্ভোগের শিকার বেশি। এখনই লাগাম টেনে ধরতে না পারলে ভয়াবহভাবে বেড়ে যাওয়া এ প্রবণতা মারাত্বকরূপ ধারণ করবে। অবশ্য এখনও খুব খারাপ অবস্থায় আছে। সরকার ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে এ প্রবণতা কমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে তবে পেরে উঠা সম্ভব হচ্ছে না। আমাদেরকেও জেগে উঠে সাহায্য-সহযোগিতা করতে হবে সরকারকে।
পত্রিকাসূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে বছরে উৎপাদন হয় পঁচিশ হাজারের বেশি ওষুধ। এরমধ্যে মাত্র চার হাজার ওষুধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ব্যবস্থা বা সামর্থ্য আছে প্রশাসনের। আর এর ২-৩ শতাংশই ভেজাল। আর বাইরের থাকা ওষুধের মান সম্পর্কে ধারণা করা কঠিন। ভয়াবহ চিত্র হচ্ছে, ২০১২ থেকে ২০১৫ সালে- এই তিন বছরের ব্যবধানে মানহীন ও ভেজাল ওষুধের সংখ্যা বেড়ে গেছে দ্বিগুণ। এখন এ হার আরও বেশি বলে মনে হয়। বাংলাদেশ ওষুধ প্রশাসনের সাথে জড়িত বিশেষজ্ঞেরা বলছেন যে, দেশে মোট উৎপাদিত ওষুধের অন্তত দুই শতাংশ পরিমাণ ভেজাল। নকল ও মানহীন হয়ে থাকে। টাকার অংকে তা প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। তবে ওষুধ সমিতির নেতারা বলে থাকেন, তাদের সদস্যেরা এ অনৈতিক কাজে জড়িত নন। চোরাগুপ্ত পথে ভেজাল ও মানহীন ওষুধ তৈরি হয়।
যেসব ওষুধে চাহিদা বেশি সেসব ওষুধের নকল বেশি তৈরি হয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন রকমের অ্যান্টিবায়োটিকের কথা বলা যায়। হারবাল নামে মানহীন ওষুধে ছেয়ে গেছে দেশ। গ্রামে ও অশিক্ষিত/অর্ধ শিক্ষিত লোকের কাছে এর চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে। এগুলোর বেশিরভাগই ভেজাল। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইচ্ছেমতো লেবেল করে মূল্য নির্ধারণ/পরিবর্তন করা হয়। সচেতনতার অভাব ও বিনা প্রেসক্রিপশনে ওষুধ বিক্রি করা এ হারকে বাড়িয়ে তুলছে বলে মনে করি। ভেজাল ওষুধে মালিক, কমিশনখোর ডাক্তার, ফার্মেসী আর বিক্রয় প্রতিনিধিরা লাভবান হচ্ছে। ফলে ভেজাল প্রবণতা বেড়েই যাচ্ছে। জীবন রক্ষাকারী ওষুধের ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের বিস্তার রোধ কোন ক্রমেই প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। প্রতিরোধের কার্যকরী তদারকি ও পদক্ষেপের অভাবে ওষুধ খাতে চলছে ভয়াবহ নৈরাজ্য। যে কারণে দেশের মানুষের জীবন হুমকির মুখে পড়তে চলেছে। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশী ওষুধের সুনাম ও রপ্তানির সাফল্যের পরও দেশ জুড়ে ওষুধের এই নৈরাজ্য বন্ধ করা যাচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবচেয়ে হতবাক হওয়ার বিষয় হচ্ছে কেবল রোগী নয়, অনেক সময় চিকিৎসকদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়, কোনটি ভেজাল ওষুধ। ফলে ঐসব প্রতিষ্ঠানের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ অল্পই রয়েছে। অভিজ্ঞতার অভাবে রোগীরা নির্ভর করছে কমিশননির্ভর ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশনের উপর। অন্যদিকে ডাক্তারদের খেয়ালখুিশ মত ঔষধ কোম্পানীগুলোর চাপিয়ে দেওয়া ঔষধ লিখে দিচ্ছেন। ঔষধ কোম্পানীগুলো দাবী করছে, গণমাধ্যমগুলোতে ওষুধের প্রচারের সুযোগ না থাকায় তাঁরা মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ দিয়ে ঔষধের মার্কেটিং করান। ১৯৮২সালের ঔষধ নীতিতে ঔষধ বিপননে প্রচারের আইনের সুযোগ করে তা রোহিত করা হয়। পাশাপাশি আইন লঙ্ঘন করে বিজ্ঞাপন দিলে জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এ কারণে কোম্পানীগুলো প্রচার ও প্রসারের জন্য ডাক্তারদের কমিশন বা বিনামূল্যে ওষুধ দিয়ে প্রচার কাজটি করতে চায়। এ অপচয় পুষিয়ে নিতে নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি করে তাদের মাধ্যমে। বড় কোম্পানীগুলোর পাশাপাশি ছোট কোম্পানীগুলোও নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রিতে পিছিয়ে নেই। শহরের বাইরে অপেক্ষাকৃত প্রত্যন্ত অঞ্চল, বস্তি ও গার্মেন্টস এলাকার ঔষধের দোকানগুলোতে ছোট কোম্পানীগুলোর ওষুধ বেশী বিক্রয় হয়। ওষুধ সম্পর্কে নূন্যতম ধারণা না থাকায় সুযোগ নেয় হাতুড়ে ডাক্তার ও ওষুধের দোকানদাররা।
পরিসংখ্যান মোতাবেক বিশ্বের ১৫ শতাংশ ওষুধ নকল। এশিয়া ও আফ্রিকার কোনো কোনো দেশে নকল ওষুধের পরিমাণ ৫০ শতাংশ। অ্যাঙ্গোলায় নকল ওষুধের পরিমাণ মোট ওষুধের ৭০ শতাংশ। ২০০৫ সালে ওইসিডি (অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের) হিসাবমতে, সারা বিশ্বে নকল ওষুধের বিক্রীত অর্থের পরিমাণ ছিল প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলার। নকল ওষুধ উৎপাদনে শীর্ষস্থানীয় দেশগুলো হল- পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, ল্যাতিন আমেরিকা, পূর্ব মধ্য ইউরোপের অনেক দেশ, আফ্রিকা এবং ভূতপূর্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন। এসব দেশে বেশি নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদিত হয় যেসব দেশে ওষুধ শিল্পে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত শিথিল এবং আইনগত বাধ্যবাধকতার অভাব রয়েছে। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর সরকার ও নীতিনির্ধারকদের দুর্নীতির কারণে নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ ও পণ্যের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় না। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, নিউজিল্যান্ড, পশ্চিম ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোয় নকল, ভেজাল নিম্নমানের ওষুধের পরিমাণ ১ শতাংশেরও কম। কারণ এসব দেশে ওষুধ এবং ওষুধ শিল্পের ওপর সরকারের কঠোর আইন ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত আছে। চীনে ওষুধ ও খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল এবং নকলের অপরাধে মৃত্যুদন্ড প্রদান করার বিধান আছে। নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করে কার্যকারিতা না পেয়ে চিকিৎসক বা রোগী একের পর এক অ্যান্টিবায়োটিক পরিবর্তন করতে থাকে। এভাবে নির্বিচারে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগে জীবাণু ওষুধের কার্যকারিতাকে নিষ্ফল করে দিয়ে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে শরীরে বহাল তবিয়তে টিকে থাকতে পারে। অন্যদিকে বেশি পরিমাণে সক্রিয় উপাদান থাকলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, বিষক্রিয়ায় রোগীর অবস্থার অবনতি হতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে রোগী মারাও যেতে পারে। আসল ওষুধের নামে ও অবয়বে মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে প্রতারণামূলকভাবে নকল উপকরণ দিয়ে, না দিয়ে বা ভেজাল দিয়ে উৎপাদিত ওষুধকে নকল ওষুধ বলে। ব্র্যান্ড ওষুধের মতো জেনেরিক ওষুধও নকল হয়। অনেক ওষুধে ঠিক উপকরণটি ব্যবহার করা হলেও তা পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে না। এসব ওষুধকে নিম্নমানের ওষুধ বলা হয়।
স্বাস্হ্য হলো মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম, দেশের যে কোন সরকারের অন্যতম অঙ্গিকার জনগনের দ্বোর গোড়ায় চিকিৎসা সুবিধা পৌছে দেয়া, কিন্তু আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ এখনো আধুনিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত। শুধু তাই নয় পদে পদে হচ্ছে প্রতারনার শিকার, এর উপর অপ চিকিৎসা, ওষুধে ভেজাল ও খাদ্য দ্রব্যে বিষাক্ত রসায়নিক মিশ্রণ মানুষকে চরম হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। সকল ভেজাল ওষুধ আর ভূয়া চিকিৎসক এ দুয়ে মিলে আজ মানুষের জীবন বিপন্ন। এব্যাপারে আমাদের সবাইকে সচেতন হওয়া জরুরি।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট, চুয়াডাঙ্গা।