বিক্ষোভের আগুনে জ্বলছে ফ্রান্স
০২ জুলাই ২০২৩, ১১:১১ এএম

পুলিশের গুলিতে ১৭ বছরের এক তরুণের মৃত্যুর পর বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে ফ্রান্স। দেশ জুড়ে বিক্ষোভকারী ও পুলিশের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। বিক্ষোভকারীরা বহু যানবাহন, স্থাপনা পুড়িয়ে দিয়েছে। বিভিন্ন স্থানে লুটপাটের ঘটনা ঘটছে। বিক্ষোভ দমনে পুলিশ এ পর্যন্ত ১ হাজার ৩০০ জনকে গ্রেফতার করেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে একটি শহরে কার্ফিউ জারি করা হয়েছে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে পূর্বনির্ধারিত জার্মান সফর বাতিল ঘোষণা করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ।
ঘটনার শুরু গত মঙ্গলবার। প্যারিসের শহরতলি নতেঁর একটি তল্লাশিচৌকিতে উত্তর আফ্রিকান বংশোদ্ভূত নাহেল মারজুক নামের ১৭ বছর বয়সি এক কিশোর পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, নির্দেশনা না মেনে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে ঐ কিশোরকে গুলি করা হয়। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, পুলিশের দুই কর্মকর্তা গাড়িটি থামানোর চেষ্টা করছেন। তাদের এক জন গাড়ির জানালা দিয়ে নাহেলের দিকে অস্ত্র তাক করেন। ঐ কিশোর গাড়িটি একটি সামনে এগিয়ে নিতেই খুব কাছ থেকে গুলি করেন পুলিশের ঐ কর্মকর্তা। কয়েক মিটার দূরে গিয়ে গাড়িটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। বার্তা সংস্থা এএফপি ভিডিওটির সত্যতা যাচাই করে বলেছে, এটিই নাহেলকে গুলি করার সেই দৃশ্য। ঐ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃত নরহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছর ফ্রান্সের ট্রাফিক তল্লাশিচৌকিতে পুলিশের গুলিতে এ নিয়ে দ্বিতীয় মৃত্যুর ঘটনা ঘটল। গত বছর এ ধরনের ঘটনায় নিহত মানুষের সংখ্যা ছিল ১৩। ঐ কিশোরের পরিবার এসেছে আলজেরিয়া থেকে। বার্তা সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ফ্রান্সের তল্লাশিচৌকিতে পুলিশের গুলিতে যত মানুষ নিহত হয়েছেন, তাদের বেশির ভাগই কৃষ্ণাঙ্গ অথবা আরব বংশোদ্ভূত।
দুঃখ প্রকাশ: বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর ঐ কিশোরকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় জড়িত ফরাসি পুলিশ কর্মকর্তা দুঃখ প্রকাশ করেন। কারাগারে থাকা ঐ পুলিশ কর্মকর্তা নিহত কিশোরের পরিবারের সদস্যদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন বলে জানিয়েছেন তার আইনজীবী। আইনজীবী লরেন-ফ্রাঙ্ক লিওনার্দ বলেন, ‘তার (অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা) প্রথম কথা ছিল, তিনি এ ঘটনার জন্য দুঃখিত এবং তার শেষ কথা ছিল, তিনি ভুক্তভোগী পরিবারের কাছে এ জন্য দুঃখ প্রকাশ করছেন। তিনি মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, মানুষ মারার জন্য সকালে ঘুম থেকে ওঠেন না তিনি। ঐ পুলিশ কর্মকর্তা নাহেলকে হত্যা করতে চাননি।’
অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তার আইনজীবী বলেন, ‘এর জেরে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতায় তার মক্কেল খুবই মর্মাহত।’
লাগামহীন বিক্ষোভ: এদিকে, ঐ ঘটনার খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে পুলিশের বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে সহিংস বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভকারীরা ব্যাপক হারে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটায়। এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ক্লামার্ত শহরে কার্ফিউ জারি করা হয়। কিন্তু কার্ফিউ উপেক্ষা করে বিক্ষোভ চলতে থাকে। পরিবহন ও শ্রমিকদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে বাস ও রেল পরিষেবা বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছেন প্যারিস অঞ্চলের প্রধান ভ্যালেরি পেক্রেসে। আকস্মিক এ ঘোষণার কারণে রাজধানী ও এর উপকণ্ঠের হাজারো যাত্রী বিপাকে পড়ে। উত্তরাঞ্চলীয় খোঁবে শহরে একটি হোটেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পর হোটেলের অতিথিদের রাস্তায় রাত কাটাতে হয়েছে। এই দাঙ্গা মোকাবিলায় এরই মধ্যে ফ্রান্স জুড়ে ৪৫ হাজারের বেশি পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলার উপায় নিয়ে আলোচনার জন্য প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রঁ এক জরুরি বৈঠক ডাকেন। নাহেলের মৃত্যু ফ্রান্সে বর্ণবাদ এবং সংখ্যালঘু জাতি-গোষ্ঠীর মানুষের প্রতি পুলিশের বৈষম্যমূলক আচরণ বলে বিক্ষোভকারীরা দাবি করেছে। গত বৃহস্পতিবার নাহেলের মায়ের নেতৃত্বে শোক মিছিল বের হয়। সেখানেও পুলিশের সঙ্গে মিছিলকারীদের সংঘর্ষ হয়।
প্যারিস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, শহরে কড়া পুলিশ পাহারা সত্ত্বেও বহু দোকানপাট লুট হয়েছে। রাস্তায় অনেক গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বন্দরনগরী মার্সেইতে দাঙ্গার সময় একটি বন্দুকের দোকানও আক্রান্ত হয়েছে। ফরাসি দৈনিক ল্য প্যারিসিয়েন খবর দিয়েছে ৩০ জনের মতো তরুণ-যুবক দোকান ভেঙে ঢুকে পাঁচ থেকে আটটি শিকার করার রাইফেল নিয়ে যায়। রোন অঞ্চলে তিন জন পুলিশ সদস্য গুলিতে জখম হয়েছে। একটি দেওয়ালের পেছনে ঘাপটি মেরে থাকা এক ব্যক্তি অতর্কিতে ঐ পুলিশ সদস্যদের ওপর গুলি চালায়। লিও শহরে গত রাতের দাঙ্গায় পুলিশের ৩৫ জন সদস্য আহত হয়েছে। তাদের দুজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। লিওতে একটি পুলিশ স্টেশনসহ আটটি সরকারি ভবনে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়। বন্দর শহর মার্সেইতে শনিবার রাতের সহিংসতা অব্যাহত থাকতে পারে এই আশঙ্কায় কর্তৃপক্ষ সন্ধ্যা ৭টা থেকে সব গণপরিবহন বন্ধ করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করে। সব বড় অনুষ্ঠানও বাতিল করা হয়। লিল শহরের রুবাইক্সে বিভিন্ন অফিস ভবনে ব্যাপক ভাঙচুর, অগ্নিকাণ্ড এবং লুঠপাট হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা বিশাল একটি অফিস ভবনে ঢুকে আগুন দেয়। সেখানে কমপক্ষে ৫০০ লোক কাজ করত। আগুনে অফিসের সবকিছু পুড়ে গেছে। বিক্ষোভ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ২০০-এর বেশি পুলিশ কর্মকর্তা আহত হয়েছেন।
নাহেলের মৃত্যুর পর ফ্রান্সে পুলিশের ক্ষমতা এবং প্যারিসের উপশহরগুলোর মানুষের সঙ্গে এই বাহিনীর সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে। উপশহরগুলোতে যারা থাকেন, তারা অর্থনৈতিক বঞ্চনা এবং বৈষম্যের শিকার বলে মনে করেন।
তৃতীয় রাতের দাঙ্গার পর চতুর্থ রাতেও প্যারিস এবং অন্যান্য শহরে ব্যাপক ধ্বংসের চিত্র দেখা গেছে। কোনো কোনো মহল থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুরো দেশে জরুরি অবস্থা জারির দাবি উঠেছে। এরকম রাস্তার বিক্ষোভ দমনের জন্য ফ্রান্সে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল ২০০৫ সালে প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাকের আমলে। এরপর ২০১৫ সালে প্যারিসে সন্ত্রাসবাদী হামলার পরও ফ্রান্সে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। সেটি জারি ছিল দুই বছর।
জানাজা: প্যারিসের শহরতলি নাতেঁরে পুলিশের গুলিতে নিহত নাহেলের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে গতকাল শনিবার। ফরাসি গণমাধ্যম জানায়, নিহত নাহেলের স্বজন এবং বন্ধুবান্ধব ছাড়াও তার মহল্লার শত শত বাসিন্দা এই জানাজায় অংশ নেয়। দাফনের আগে স্থানীয় ইবনে বাদিস মসজিদেও জানাজা হয়। নাহেলের পরিবার এসব অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের ঢুকতে দেয়নি। এরপর কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে তার দাফন সম্পন্ন হয়।