মরক্কোর ভূমিকম্প থেকে শিক্ষা নিয়ে সচেতন হতে হবে

মো. জিল্লুর রহমান

১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:২৮ এএম


মরক্কোর ভূমিকম্প থেকে শিক্ষা নিয়ে সচেতন হতে হবে

মো. জিল্লুর রহমান।

 

তিসম্প্রতি (৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ শনিবার) মরক্কোর মধ্যাঞ্চলে ৬.৮ মাত্রার একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের তথ্যমতে এতে এখন পর্যন্ত অন্তত ২ হাজারের অধিক মারা গেছে। এর আগেও বেশ কয়েকবার মরক্কোতে ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে।

 

২০০৪ সালে দেশটির উত্তর-পূর্বের আল হোসেইমা অঞ্চলে ভূমিকম্পে ৬২৮ জন মারা গিয়েছিল এবং ১৯৬০ সালে আগাদির অঞ্চলে ভয়াবহ ভূমিকম্পে অন্তত ১২ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। এর থেকে আশঙ্কা করা যায় যে এবারের ভূমিকম্পেও হতাহতের সংখ্যা বিপুল পরিমাণে বাড়তে পারে। মরক্কোর এবারের ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল অ্যাটলাস পর্বতমালার মধ্যে এবং এ অঞ্চলটি এতটাই দুর্গম যেখানে ত্রান ও চিকিৎসা সহায়তা পৌঁছানো যথেষ্ট কষ্টসাধ্য।

 

অনেকেরই হয়তো স্মরণে আছে চলতি বছর ৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্ক-সিরিয়ার সীমান্ত অঞ্চলে ৭.৮ মাত্রার ভয়াবহ এক ভূমিকম্প আঘাত হানে এবং ওই অঞ্চলে এর কয়েক ঘণ্টা পরে ফের ৭.৬ মাত্রার ‍ভূকম্পন অনুভূত হয়। এতে তুরস্কের দক্ষিণ এবং সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ‘শতাব্দীর ভয়াবহতম’ এ ভূমিকম্পে প্রাণহানির সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়েছিল। কেবল তুরস্কেই মারা গেছে ৪৪ হাজারের বেশি এবং সিরিয়ায় প্রায় ৬ হাজার প্রাণহানি হয়েছে। ভূমিকম্পে অন্তত ১ লাখ ৭৩ হাজার ভবন ধসে পড়েছে বা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং গৃহহীন হয়েছেন ২০ লাখেরও বেশি মানুষ।

 

ভূমিকম্প পৃথিবীতে নতুন কিছু নয়, বরং পৃথিবীর অভ্যন্তরে ভূ-আন্দোলনের ফলে উৎপন্ন আকস্মিক শক্তি গুলির মধ্যে অন্যতম হল ভূমিকম্প। এটি এমন একটি প্রাকৃতিক ঘটনা যা পৃথিবীর আকস্মিক কম্পন হিসাবে নিজেকে প্রকাশ করে যা মাত্র কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হয়। এটি পৃথিবীর ভূত্বকের গভীরে ব্যাঘাতের ফলে বা ভূত্বকের মধ্যে গোলযোগের ফলে ঘটে। ভূমিকম্প প্রায়ই পৃথিবীর গভীরে ঘটলেও ভূপৃষ্ঠ থেকে দেখা যায় না। যে কোনো মুহূর্তে পৃথিবীর পৃষ্ঠে বড় ধরনের ভূমিকম্প ঘটতে পারে এবং সেগুলো বিধ্বংসী হতে পারে। ভূমিকম্পের ফলে ভূমিরূপের পরিবর্তন সাধিত হয়, সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয় ও মানুষের প্রাণহানী ঘটে। আসলে সারা পৃথিবীব্যাপী প্রতিদিনই প্রায় অসংখ্য ভূমিকম্প সংঘটিত হয়ে থাকে, যার মধ্যে আমরা সামান্য কিছু অনুধাবন করতে সক্ষম হই।

 

ভূমিকম্পের ফলে ভূপৃষ্ঠের যেমন নানা রূপ পরিবর্তন সাধিত হয়, তেমনি বহু প্রাণহানি ও জনপদ ধ্বংস হয়। প্রথমত, ভূমিকম্পের ফলে ভূপৃষ্ঠে অসংখ্য ফাটল ও চ্যুতির সৃষ্টি হয়। এই সব ফাটলের মধ্যে দিয়ে ভূগর্ভস্থ গরম জল ও বাষ্প বাইরে বেরিয়ে আসে। আবার চ্যুতির সৃষ্টি হলে ভূভাগ উপরে উঠে বা নিচে নেমে স্তূপ পর্বত ও গ্রস্ত উপত্যকার সৃষ্টি করে। দ্বিতীয়ত, ভূমিকম্পের ফলে ধ্বসজনিত কারণে নদীর গতিপথ রুদ্ধ হলে নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। যেমন - ১৯৫০ সালের ভূমিকম্পে আসামের দিবং নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়েছিল। তৃতীয়ত, অনেক সময় সমুদ্র নিচে প্রবল ভূমিকম্প হলে সমুদ্র তলদেশের কোন অংশ উত্থিত হয়ে সামুদ্রিক দ্বীপ আবার অনেক সময় সমুদ্র মধ্যবর্তী অনেক দ্বীপ সমুদ্র তলদেশে অবনমিত হয়ে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।চতুর্থত, সমুদ্র তলদেশে প্রবল ভূমিকম্প সংঘটিত হলে সমুদ্রের জল ব্যাপক ও বিধবংসী তরঙ্গের আকারে উপকূলের দিকে এগিয়ে এসে ব্যাপক ধবংসলীলা চালায়। এই সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসকে সুনামি বলে। যেমন - ২০০৪ সালে ভারত মহাসাগরে এই রূপ সুনামি সংঘটিত হয়েছিল। পঞ্চমত, ভূমিকম্প যেহেতু আকস্মিক ঘটনা, তাই হঠাৎ করে প্রবল ভূমিকম্প হলে শহর ও নগর নিমেষে ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়। অসংখ্য মানুষ, জীবজন্তু মৃত্যু মুখে পতিত হয়। রাস্তাঘাট, রেল, বাঁধ, সেতু ধ্বংস হয়ে যায়, যা তুরস্কের ভূমিকম্পে দৃশ্যমান।

 

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে ৮টি ভূতাত্ত্বিক চ্যুতি এলাকা বা ফল্ট জোন সচল অবস্থায় রয়েছে, এগুলো হলো বগুড়া চ্যুতি এলাকা, রাজশাহীর তানোর চ্যুতি এলাকা, ত্রিপুরা চ্যুতি এলাকা, সীতাকুণ্ড টেকনাফ চ্যুতি এলাকা, হালুয়াঘাট চ্যুতির ডাওকী চ্যুতি এলাকা, ডুবরি চ্যুতি এলাকা, চট্টগ্রাম চ্যুতি এলাকা, সিলেটের শাহজীবাজার চ্যুতি এলাকা (আংশিক-ডাওকি চ্যুতি) এবং রাঙামাটির বরকলে রাঙামাটি চ্যুতি এলাকা। এছাড়া, বাংলাদেশ, ভারতীয়, ইউরেশীয় এবং বার্মার (মায়ানমারের) টেকটনিক প্লেটের মধ্যে অবস্থান করছে। ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গলে ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয় এবং ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বরে ৬.০ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের মানমন্দিরে ২০০৭ সালের মে থেকে ২০০৮ সালের জুলাই পর্যন্ত কমপক্ষে ৯০টি ভূ-কম্পন নথিভুক্ত করা হয়, তন্মধ্যে ৯টিরই রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিলো ৫-এর উপরে, এবং সেগুলোর ৯৫% এরই উৎপত্তিস্থল ছিলো ঢাকা শহরের ৬০০ কিলোমিটারের মধ্যে। বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশকে ভূমিকম্পের তীব্রতার ভিত্তিতে তিনটি জোনে ভাগ করা হয়েছে। বুয়েটের গবেষকদের প্রস্তুতকৃত ভূ-কম্পন এলাকাভিত্তিক মানচিত্রে দেখা যায়, বাংলাদেশের ৪৩% এলাকা ভূমিকম্পের উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে (জোন-১), ৪১% এলাকা মধ্যম (জোন-২) এবং ১৬% এলাকা নিম্ন ঝুঁকিতে (জোন-৩) রয়েছে। যেখানে ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ভূ-কম্পন মানচিত্রে ২৬% উচ্চ, ৩৮% মধ্যম এবং ৩৬% নিম্ন ঝুঁকিতে ছিলো। অতীতের এসব রেকর্ডকে প্রাধান্য দিয়ে গবেষকরা বলছেন, যে কোনও সময় বাংলাদেশে রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে এবং এজন্য এখন থেকেই আমাদের পূর্ব প্রস্তুতি ও সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ।

 

ভূমিকম্প থেকে রক্ষা পেতে হলে আগে থেকেই কিছু পূর্ব প্রস্তুতি ও সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। ভূমিকম্প প্রবণ এলাকায় বিল্ডিং এমনভাবে ডিজাইন করা উচিত যাতে তারা বড় কম্পন সহ্য করতে পারে। একটি নতুন কাঠামো নির্মাণের আগে, মানুষের সর্বদা স্থপতি এবং প্রকৌশলীদের সাথে পরামর্শ করা উচিত। ভবনের ছাদ উজ্জ্বল রাখা দরকার। বিল্ডিং নির্মাণে শক্তিশালী উপকরণ ব্যবহার করা উচিত নয়, কারণ এগুলোতে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি ঘটে বেশি; পরিবর্তে, কাঠ বা মাটির কাদা ব্যবহার করা উচিত। ছবির ফ্রেম, গিজার, ঘড়ি এবং অন্যান্য দেয়াল এমন জায়গায় ঝুলিয়ে রাখতে হবে যেখানে পড়ে গেলে কারো ক্ষতি হবে না। যেহেতু ভূমিকম্প আগুনের কারণ হতে পারে, ভবনগুলিকে অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম দিয়ে সজ্জিত করা উচিত। যদি বাড়িতে অবস্থান করে, যতদ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং সম্ভব না হলে ঝামেলা স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত টেবিলের নিচে লুকাতে হবে। লম্বা বা ভারী জিনিসের আশেপাশে দাঁড়ানো বা বসা এড়িয়ে চলতে হবে। আপনি যদি বিছানায় থাকেন তবে এটি থেকে বের না হওয়াই শ্রেয় এবং আপনার পিঠ কুশন করার জন্য একটি বালিশ ব্যবহার করুন। আপনি যদি বাইরে থাকতে যাচ্ছেন বিল্ডিং, গাছ, এবং পাওয়ার লাইন থেকে দূরে ড্রপডাউন. আপনি যদি একটি গাড়ি বা বাসে থাকেন, তবে ধীরে ধীরে নিরাপদ স্থানে যান এবং ভূমিকম্প শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভিতরে থাকুন।

 

আসলে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস জানানো খুবই জটিল। গবেষকরা কোনো নির্দিষ্ট ভূমিকম্পকে সরাসরি নির্ণয় করতে পারে না, কিন্তু মাইক্রোসিসমিসিটি গবেষণা, ফোকাল ম্যাকানিজম গবেষণার মাধ্যমে সম্ভাব্য পূর্বাভাস এবং ঝুঁকিপূর্ণ স্থান, হাইসিসমিসিটি, লোসিসমিসিটি নির্ণয় করতে পারে, যা জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ জীবন ও সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতি রোধে অত্যন্ত সহায়ক। বিশেষজ্ঞদের মতে ভূমিকম্প বিষয়ক দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য সরকারের একটি সুস্পষ্ট কর্মপরিকল্পনা জরুরি প্রয়োজন। বাংলাদেশ প্লেট বাউন্ডারির অন্তর্ভুক্ত না হয়েও দুর্বল অবকাঠামো, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, প্রয়োজনীয় বিল্ডিং কোড মেনে না চলার কারণে এবং যত্রতত্র ভবন ও স্থাপনা নির্মাণের ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের একটি অন্যতম ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। যেহেতু ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, একে থামিয়ে রাখা সম্ভব নয়। সেহেতু ভূমিকম্প পূর্বপ্রস্তুতি ও ক্ষয়ক্ষতি রোধে ভূমিকম্প-পরবর্তী শক্তিশালী এবং কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই এই দুর্যোগ মোকাবিলা সম্ভব। মরক্কো ও সাম্প্রতিক তুরস্কের ভয়াবহ ভূমিকম্প থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের এখনই সচেতন ও সতর্ক হতে হবে।

 


ব্যাংকার ও কলাম লেখক,
সতিশ সরকার রোড, গেন্ডারিয়া, ঢাকা।

Ads