ঢাকা, মঙ্গলবার   ৩০ মে ২০২৩,   জ্যৈষ্ঠ ১৬ ১৪৩০

ঢাকার বাতাসে পোড়া গন্ধ !!!

মো: আসাদুজ্জামান

প্রতিদিনের চিত্র

প্রকাশিত : ১১:৩৩ এএম, ১৮ মার্চ ২০২৩ শনিবার

রাজধানী ঢাকাতে একের পর এক বিস্ফোরণ কিংবা অগ্নিকাণ্ডের তান্ডবে আতংকে নগরবাসী। শুধু আতংক নয় একেক ঘটনায় পোড়া লাশ হয়ে পরিবারের কাছে ফিরছে অনেকেই। সন্তান হারা মা, স্বামী হারা স্ত্রী কিংবা ভাই হারা বোনের কান্নায় ঢাকার বাতাস এখন বড্ড ভারি।

 

একটি বিস্ফোরণ কিংবা অগ্নিকাণ্ডের  ফলে যে ক্ষতি হয় সেটির ফল একজন মানুষের পরিবার আজীবন বয়ে বেড়ায়। বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্টি হয় মানবেতর অবস্থা। আর সেই বিস্ফোরণ যদি কোনো ভবনে হয় সেক্ষেত্রে ক্ষতির মাত্রা থাকে অপূরণীয়।

 

প্রতিটি ঘটনা তদন্ত শেষে জানা যায়, ভবনে বিস্ফোরণ হয়েছিল এসি কিংবা বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা ত্রুটি থেকে । কারো অবহেলা কিংবা নিয়ম না মানার সংস্কৃতি আমাদের দিনকে দিন যে ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে এর কি কোন প্রতিকার নেই ?

 

এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া এখন বড্ড কঠিন আর উত্তর মিললেও সেটি কাগুজে কলমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যেকোনো দুর্ঘটনা শেষে একটা মেজর পয়েন্ট পাওয়া যায় সেটি হলো - নিরাপত্তা আইন লঙ্ঘনের ফলাফল হলো 'বিস্ফোরণ' । এর মধ্যে দাহ্য পদার্থ সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করা, দাহ্য পদার্থে আগুন লেগে যাওয়া ও গ্যাস লিকেজ অন্যতম।

 

এসব বিস্ফোরণ রাসায়নিক পদার্থ, গ্যাস লিকেজ বা ইলেকট্রিক শর্ট সার্কিট যে কারণেই হোক না কেন তার জন্য মূলত অব্যবস্থাপনা আর নিয়ম না মানার প্রবণতা দায়ী।

 

প্রায় সবকয়টি  বিস্ফোরণের পর  তদন্ত কমিটি  একটি কারণ খুঁজে বের করেন। আর সেই কারণটি আরও নিখুঁত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অব্যবস্থাপনা আর অসচেতনতা  জন্যই ঘটে এসব দুর্ঘটনা। আমাদের অবহেলার কারণেই এতো বড় একটি ক্ষতির কারণ ধীরে ধীরে সৃষ্টি হয়েছে। তার পরেও ধারাবাহিক ভাবে ঘটে যাচ্ছে এই ভয়াবহতা।

 

২০১০ সালে নিমতলি অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জনের মৃত্যু হয়। ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আজও আমরা ভুলিনি। সে ঘটনায় হয়েছিল তদন্ত কমিটি। বিশেষজ্ঞরা নানান পরামর্শ দিয়েছিল। নিমতলির তদন্ত কিংবা সচেতনতার ফলাফল কি চকবাজারের ঘটনা?  তারপরে চকবাজারেও ঘটেছিল ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। পুরাতন ঢাকা যেন বিস্ফোরণ কিংবা অগ্নিকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল।

 

সম্প্রতি  সাইন্সল্যাবের বিস্ফোরণের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গুলিস্থানের ফুলবাড়িয়া ঘটনা আমাদের আরও বেশী ভাবিয়ে তুলেছে। ফুলবাড়িয়ার বিস্ফোরণ ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ২১ জন। আহতের সংখ্যা শতাধিক।

 

আর কত লাশের পর এসব ঘটনা থেকে মুক্তি মিলবে? আর কত পরিবারের কান্না, আহাজারির পর আমরা নিয়ম মেনে চলব?
বার বার কেন ঘটছে এসব ঘটনা।  এ প্রশ্ন এখন জনমনে।

 

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বদ্ধ গ্যাস থেকে ভবনগুলোতে বিস্ফোরণ-অগ্নিকাণ্ডের মতো  ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে থাকে।প্রতিটি ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, মূলত ‘অক্সিজেন, দাহ্য পদার্থ এবং তাপ’ এই তিনটির সমন্বয়ে একসাথে ঘটছে ভয়ানক বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এবং এই বিস্ফোরণ এতোটা মারাত্মক হয় যে, নিমিষেই একটি ভবন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

 

সম্প্রতি গুলিস্থানের ঘটনা (তদন্ত রিপোর্টের আগে) এসি বিস্ফোরণের কারণেই অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে ।

 

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভবনে বা কক্ষে বিস্ফোরণ সাধারণ গ্যাস থেকে সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। কোনো না কোনোভাবে গ্যাসের লিকেজ থাকে। সেই গ্যাস যখন বদ্ধ অবস্থায় থাকে তখনই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এসব ক্ষেত্রে কখনো কখনো ন্যাচারাল গ্যাস আবার মিথেন গ্যাসের উপস্থিতিও পাওয়া যায়। এর বাইরেও বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট, পুরোনো গ্যাসের লাইন বা নানা ধরনের দাহ্য পদার্থ থেকেও বিস্ফোরণ বা আগুনের সূত্রপাত ঘটে থাকে। সাধারণত ঘরে থাকা এসির কনডেনসারে ময়লা থাকলে কম্প্রেসরে হাই টেম্পারেচার ও হাই প্রেশার তৈরি হয়ে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। এসির ভেতরের পাইপের কোথাও ব্লকেজ হলে এসির ভেতরে হাই প্রেশার তৈরি হয়ে কম্প্রেসর ব্লাস্ট হতে পারে। যার ফলে ঘটে বড় দুর্ঘটনা।

 

ভবন নির্মাণে ত্রুটির কারণেও অনেক সময় ভবনে বিস্ফোরণ হতে পারে বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ। এসব ত্রুটিপূর্ণ অবকাঠামোর জন্য অনেক সময় ভবনে বিস্ফোরণ হয়ে থাকে । ভবন নির্মাণের সময় যদি সঠিকভাবে সেখানে বাতাস নির্গতের ব্যবস্থা থাকে সেক্ষেত্রে বিস্ফোরক সৃষ্টি থেকে অনেকটা রক্ষা পাওয়া যায়।

 

প্রতিটি ঘটনা তদন্তে একটা বিষয় বেড়িয়ে আসে, আমাদের অসচেতনতা কিংবা নিয়ম না মেনে কাজ করা। যার ফলশ্রুতিতে একেকটা ঘটনায় প্রাণ যায় অনেক মানুষের। একটা ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আরেকটা ঘটনা শুরু হয়। বাতাসে পোড়া লাশের গন্ধ আমরা আর চাইনা। একটি বাসযোগ্য ঢাকা চাই আমরা।

 

আমাদের সচেতনতায় পারে একটি বাসযোগ্য রাজধানী উপহার দিতে। ভয়াবহ এসব ঘটনার নেপথ্যে যারা থাকে প্রকৃত তদন্তে তাদের শাস্তির আওতায় আনা উচিৎ।

 

বাতাসে পোড়া লাশের গন্ধে আমাদের জনমনে আতংক বিরাজ করছে। একেকটা লাশ যেন একেকটা পরিবারকে অসহায় করে তুলছে। স্বজন হারানোর কষ্টটা যাদের হারায় তারা শুধু বোঝে।

 

এসব ঘটনার স্থায়ী সমাধান দরকার। নিয়ম মানার সংস্কৃতি চালু হউক সবখানে। অপরাধী যেই হউক যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত হউক। একটা বাসযোগ্য রাজধানী হউক আমাদের ঢাকা।

 

লেখক: ব্যাংকার ও কলাম লেখক।