নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী আমাদের অহংকার
২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১১:২২ এএম

শিক্ষা, সমাজকল্যাণ ও সেবাব্রতে নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর কথা যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন তা ইতিহাসে বিরল। উপমহাদেশে তিনিই সর্বপ্রথম উপলব্ধি করেছিলেন পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও শিক্ষার যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে। আর এই প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেই তিনি নারীশিক্ষার প্রতি বিশেষ মনোযোগী হয়ে পড়েন। ১৮৩৪ সালে কুমিল্লা জেলার হোমনাবাদ পরগনার (বর্তমানে লাকসামের) এলাকার রাক্ষুসী খরস্রোতা ডাকাতিয়া নদীর তীর ঘেষা পশ্চিমগাঁয়ে জন্মগ্রহণ করেন নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী। তিনি ব্রিটিশ শাসনাধীন উপমহাদেশের প্রথম মুসলমান মহিলা নওয়াব এবং নারী শিক্ষার রূপকার ও প্রজাবৎসল জমিদার ছিলেন।
বাবা আহমেদ আলী চৌধুরী আর মা আরাফান্নেসা চৌধুরাণী । বাবা ছিলেন একজন নামকরা জমিদার। আহমেদ আলীর পূর্বপুরুষ দিল্লির বাদশাহ শাহ আলমের কাছ থেকে সনদ লাভ করে হোমনাবাদ পরগনার জমিদার হন। পিতামাতার অতি আদরের ছিলেন ফয়জুন।জমিদার বংশের সন্তান হিসেবে বেশ আরাম-আয়েশের মধ্য দিয়ে তিনি বেড়ে ওঠেন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তার অবস্থান ছিল তৃতীয়। দুই ভাই এয়াকুব আলী চৌধুরী ও ইউসুফ আলী চৌধুরী, দুই বোন লতিফুন্নেসা চৌধুরানী ও আমিরুন্নেসা চৌধুরানী।
ছোটবেলা থেকে লেখাপড়ায় তাঁর প্রচুর আগ্রহ দেখে তার বাবা তার জন্য একজন গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করেন। তাঁর নাম ছিলো তাজউদ্দিন। তিনি কঠোর নিয়মানুবর্তিতা পালন করে তাঁর জ্ঞানস্পৃহাকে আরো উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করে তোলেন। ফয়জুন্নেসা জীবনে কোনো দিন স্কুলে যাননি। কারণ সে সময়ে তিনি সমাজের রক্ষণশীলতা ভঙ্গ করতে চাননি। গৃহশিক্ষকের সাহায্যে ফয়জুন্নেসা খুব দ্রুত কয়েকটি ভাষার উপর গভীর জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হন। অত্যন্ত জ্ঞানস্পৃহায় তিনি বাংলা, আরবি, ফার্সি ও সংস্কৃত-এই চারটি ভাষায় শিখেন।
পিতার দিকের দূর সম্পর্কের আত্মীয় ছিলেন বরুড়া উপজেলার কাশিমপুরের জমিদার (যা পরবর্তিতে বাউকসার নামে পরিচিত) মোহাম্মদ গাজী চৌধুরী। গাজী চৌধুরী নিজেই কিশোরী ফয়জুন্নেছার জন্যে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে এক লক্ষ স্বর্ন মূদ্রা দেনমহরে ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ও গাজী চৌধুরী বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। পরবর্তীতে পঞ্চাশ হাজার করে দুই কিস্তিতে ফয়জুন্নেছাকে মোহাম্মদ গাজী দেনমহর পরিশোধ ও করিয়া দেন। গাজী চৌধুরীর একান্ত আগ্রহেই এই বিয়ে সুসম্পন্ন হলেও ফয়জুন্নেসার দাম্পত্য জীবন সুখের হয়নি। মাত্র ৬-৭ বছরের মাথায় বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। ফয়জুন্নেসা গাজী চৌধুরীর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী ছিলেন। আরশাদুন্নেসা ও বদরুন্নেসা নামে তাদের দু’টি কন্যা সন্তান হয়। বিবাহ বিচ্ছেদের পর গাজী চৌধুরীর নির্দেশে বড় মেয়ে আসাদুন্নেছা বাবা কাছে থাকতে বাধ্য হয়। ছোট মেয়ে বদরুন্নেছা মায়ের কাছেই মানুষ হয়। বিচ্ছেদের পর থেকেই ফয়জুন্নেসা সমাজ সংস্কার ও গঠনমূলক কাজে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন।
ফয়জুন্নেসা এ বিষয়ে তার লিখিত রূপজালাল গ্রন্থে লিখেছেন,
‘মোহাম্মদ গাজী চৌধুরী আমাদের আত্মীয় এক মহামান্য ভূ-স্বামীর সন্তান। মাতৃ-পিতৃহীন হওয়াতে পিতা তাহাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। আমাদের আলয়ে তাঁহার সর্বদা গমনাগমন ছিল। এক দিবস আমাকে দর্শন করিয়া তাঁহার চিত্ত চঞ্চল হইয়া উঠিল। কিন্তু নাবালিকা বিধায় আমার পিতা-মাতা এ বিষয়ে অসম্মতি জানান। তাতে তরুন প্রেমিক গাজী, ভাবাবেগে সংসারের প্রতি অনাসক্ত হয়ে উদসীনভাবে ঘুরে বেড়াতে থাকেন।'
পিতার মৃত্যু, মায়ের অসহায়তা, গাজী চৌধুরীর লোককের দৌত্যকার্য সব মিলে ঘটনা প্রবাহের মোড় ফিরে যায়। মোহাম্মদ গাজী চৌধুরী আবার ফয়জুনকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব দিতে থাকেন। অনেকটা বাধ্য হয়ে ফয়জুন্নেছার মা বিবাহে সম্মতি দিলেন।
তবে শর্ত ছিল- ‘ফয়জুন্নেছা সতীনের সঙ্গে একত্রে বাস করতে ভাউকসার যাবেন না। পশ্চিমগাঁয়েই থাকবেন। গাজী চৌধুরীর কাছে তখন ফয়জুন্নেছাকে পাওয়াই ছিল বড় কাজ, তাই তিনি উক্ত শর্তেই রাজি হয়ে যান। তবে এ বিয়েতে গাজী চতুরতার আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানা যায়। বিয়ের পর ফয়জুন্নেছা মায়ের কাছেই থেকে গেলেন। কয়েক বছর বেশ সুখেই কাটে। এর মাঝে আরশাদুন্নেছা ও বদরুন্নেছা নামে দুইকন্যা সন্তানও জন্ম নেয়। ইতোমধ্যে এক সময়ে গাজীর মনে ফয়জুন্নেসাকে নিজ বাড়িতে নেওয়ার অভিলাষ জন্মে। কিন্তু সরাসরি প্রস্তাবে না গিয়ে দুষ্টবুদ্ধির প্রণোদিত হয়ে অপকৌশল অবলম্বন করেন। কোন এক জোসনা রাতে গাজীর বজরা করে নদীতে ঘুরে আসার প্রস্তাবে সানন্দে রাজি হন ফয়জুন্নেছা। রাত বেড়ে যাচ্ছে এবার ফেরা যাক। ফয়জুন্নেসার বারবার তাগাদা সত্ত্বেও গাজীর ইশারায় বজরা এসে ভিড়ে ভাউকসার জমিদার বাড়ির ঘাটে। গাজী বিনয়াবনত কন্ঠে ফয়জুন্নেসাকে বজরা থেকে নেমে বাড়িটি এক নজর দেখার অনুরোধ করে। এদিকে বাড়ির অভ্যন্তরে তখন চলছে অভ্যর্থনার ঘটা।
ফয়জুন্নেছার কাছে স্বামীর চাতুরী স্পষ্ট হয়ে যাওয়ায় তিনি বজরা থেকে নামতে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু গাজী ফয়জুন্নেসাকে নামতে বাধ্য করেন। চরম অসন্তোষের সঙ্গে ফয়জুন্নেসা বাধ্য হয়ে গাজীর বাড়িতে প্রবেশ করেন। স্বামীর বাড়িতে সাতদিন অবস্থান করলেও এ সাতদিন স্বামীর বাড়ির কোন কিছু স্পর্শ করেন নি। খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে খাওয়ার পানি, গোসলের, এমনকি অজুর পানি পর্যন্ত পশ্চিমগাঁও থেকে সরবরাহ করা হয়েছে। সাতদিন পর স্বেচ্ছায় চলে আসার উদ্যোগ নের ফয়জুন্নেসা। বজরাও প্রস্তুত হয়। সেই মুহুর্তে গাজীর কাছ থেকে তিনি শোনেন এক নিষ্ঠুর প্রস্তাব। ফয়জুন থাকুক বা না থাকুক তাতে গাজী চৌধুরীর আপত্তি নেই, তবে গাজীর এক সন্তান তাঁর বাড়িতেই থাকবে।
শাসকরূপে তিনি নিজেই ঘোড়ায় চড়ে বিভিন্ন মৌজায় গিয়ে প্রজাদের সুখ-দুঃখের খবরাখবর নিতেন। প্রজাদের অভাব অভিযোগ লাঘবের চেষ্টা করতেন। প্রজাদের সুবিধার্থে নির্মাণ করেছেন বিভিন্ন মৌজায় খাল, পুকুর, রাস্তাঘাট, স্কুল, মুসাফিরখানা, দাতব্য চিকিৎসালয়, মাদ্রাসা-মক্তব ইত্যাদি। তার দানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল লাকসাম দাতব্য চিকিৎসালয়। যা এখনো সগৌরবে মানুষের কাজে আসছে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মানুষকে আলোকিত করার জন্য শিক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও জনহিতকর কর্মযজ্ঞ আমৃত্যু অব্যাহত রেখেছিলেন নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী। সামাজিক সংকট, নিমর্মতা, অসত্য, তাকে নিদারুণ কষ্ট দিয়েছে ঠিকই, তবে পরক্ষণে তিনি প্রতিরোধে উজ্জীবিত হয়েছেন এবং কাজের মধ্য দিয়ে প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতাকে কাজে লাগিয়ে প্রজা ও সাধারণ মানুষকে সঠিক নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। দেশে বিদেশে শিক্ষার প্রচারে তার অবদান অনস্বীকার্য। নওয়াব ফয়জুন্নেসা (পশ্চিমগাঁয়ে) একটি অবৈতনিক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মাদ্রাসার ছাত্রদের অন্য একটি ছাত্রাবাসও ছিল। মাদ্রাসার ভালো ফলাফলে উৎসাহিত হয়ে পরবর্তিকালে তাঁর (ফয়জুন্নেসার) বংশধরগণ ১৯৪৩ খ্রীঃ এটিকে উচ্চ মাধ্যমিক ইসলামিক কলেজে রূপান্তরিত করেন। ১৯৬৫খ্রীঃ কলেজটি একটি ডিগ্রী কলেজে রূপান্তরিত হয়ে ''নওয়াব ফয়জুন্নেসা ডিগ্রী কলেজ'' নামে আখ্যায়িত হয়। ১৯৮২খ্রীঃ এ কলেজটির সরকারিকরণ হয় এবং নাম হয় "নওয়াব ফয়জুন্নেসা সরকারি কলেজ"।
তিনি ১৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, অনেক গুলো দাতব্য প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, এতিমখানা এবং সড়ক নিমার্ণ করে তার মানবতাবাদী ও সমাজ সংস্কারের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তিনি নওয়াব বাড়ীর সদর দরজায় একটি দশ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৪ সালে পবিত্র হজ্ব পালন করার সময় তিনি মক্কায় হাজীদের জন্য একটি 'মুসাফিরখানাও প্রতিষ্ঠা করেন। নওয়াব ফয়জুন্নেসা হজে যাওয়ার আগে নিজের বসতবাটিসহ সমস্ত সম্পদ জনকল্যাণে দান করেছিলেন। তিনি তার ওয়াকফা দলিলের প্রারম্ভেই বলেছেন-
'জগৎপিতা জগদ্বীশ্বরের কৃপায় আমি পার্থিব সর্বপ্রকার মান-সম্ভ্রম ও ঐশ্বর্য এবং ঐহিক সুখ-স্বচ্ছন্দতা বিপুল পরিমাণে ভোগ করিয়াছি। এই ক্ষণ আমার বৃদ্ধাবস্থা উপস্থিত বিধায় ইহকালের বৈষয়িক চিন্তাজাল হতে নিষ্কৃতি লাভ পারমার্থিক এ পারত্রিক উপকারজনক কার্যে মনোনিবেশ করাই সর্বেব্ববভাবে কর্তব্য।'
শিক্ষা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে তিনি মেয়েদের স্বাস্থ্য রক্ষাও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। শুধুমাত্র নারীদের চিকিৎসার জন্য ১৮৯৩ সালে কুমিল্লা শহরের দক্ষিন চর্থায় তৎকালীন এক দুস্থ পল্লীতে ফয়জুন্নেসা হাসপাতালটি স্থাপন করেন। হাসপাতলে ইংরেজ ডাক্তার এবং দেশী খ্রিস্টান নার্সদের সমাবেশ ঘটেছিল। ১৮৯৩ সালেই কুমিল্লায় ‘বেঙ্গল ব্রাঞ্চ-কাউন্টারস অব ডাফরিন ফান্ড কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটি মহিলাদের চিকিৎসা কর্মসূচিতে আগ্রহ প্রকাশ করে। ফয়জুন্নেসা তখন তাঁর হাসপাতাল চিকিৎসা ব্যবস্থায় উন্নতমান রক্ষিত হবে ভেবে হাসপাতালটি উক্ত কমিটির হাতে ন্যস্ত করেন। উক্ত কমিটির তত্ত্বাবধানেই হাসপাতালটি সে স্থানে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত পরিচালিত হয়। সে সময়ে অর্থাৎ ১৯২৯ সালেই কুমিল্লার সদর হাসপাতালটি যা বহুকাল যাবত গোমতি নদীর পাড়ে গোয়াল পট্টীর উত্তরে অবস্থিত ছিল তা উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে দক্ষিন চর্থায় স্থানান্তরিত হয়। চিকিৎসার সুবিধার্থে তখন ফয়জুন্নেসা হাসপাতালটিও সদর হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাব ওঠে যা এক রেজিস্ট্রীকৃত দলিলে ১০/০৭/১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তদলব্ধ অর্থে নির্মিত সদর হাসপাতালের পূর্বাংশে অবস্থিত দেয়াল ঘেরা দ্বিতল দালানটিতে ফয়জুন্নেসা হাসপাতালটি বর্তমানে নবান ফয়জুন্নেসা ফিমেল ওয়ার্ড নামে পরিচিত।
নওয়াব ফয়জুন্নেসা ছিলেন জনকল্যাণের নিবেদিত প্রাণ। তৎকালীন ত্রিপুরা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার ডগলাস একটি জনহিতকর কর্মে নিয়োজিত হয়ে বিশেষভাবে অর্থ সংকটে পতিত হন। সরকারি কোষাগারের অর্থ পেতে বিলম্ব হবে বিধায় তিনি স্থানীয় ধনাঢ্য ও জমিদারদের নিকট থেকে সাময়িকভাবে অর্থ-ঋণের প্রস্তাব করলে কেউ তার এই প্রস্তাবে সায় দেয়নি। কিন্তু নওয়াব ফয়জুন্নেসা প্রকল্পটি জনহিতকর জেনে প্রয়োজনীয় অর্থ প্রদান করেন এবং ঘোষণা দেন ঋণ নয়, তিনি স্বেচ্ছায় দান করেছেন। মিস্টার ডগলাস নওয়াব ফয়জুন্নেসার এরূপ দানে বিস্ময় প্রকাশ করে মহারানী ভিক্টোরিয়াকে অবহিত করেন। রানী ফয়জুন্নেসার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তাকে ‘বেগম’ উপাধি দেওয়ার ঘোষণা করেন। রানীর ঘোষিত এই উপাধি তিনি বিনয়াবনতভাবে প্রত্যাখ্যান করে জানান, জমিদার কন্যা ও জমিদার পত্নী হিসেবে এমনিতে তিনি বেগম নামে সুপরিচিত। নতুন করে আবার পরিচিতির প্রয়োজন নেই। মহারানী ভিক্টোরিয়া জমিদার নন্দিনীর এমন সিদ্ধান্তে আশাহত না হয়ে এই গুরুত্ব উপলব্ধি করে অবশেষে ‘নওয়াব’ উপাধি দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
ইংরেজ সরকার কর্তৃক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিপীড়নের ফলেই মুসলমানরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থেকেছে। ফলে তাদের মধ্যে এমন সব কুসংস্কার এসে বাসা বেঁধেছে যা তৎকালীন নারী সমাজের সর্বাধিক দুঃখের ও কষ্টের কারন হয়েছে। মুসললানেরা তা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বুঝতে পারে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে। তখন থেকেই এর পরিবর্তন আনতে সচেতন হতে শুরু করে অনেকে। সমাজ পরিবর্তনের এ দায়িত্ব যারা হতে তুলে নিয়েছিলেন ফয়জুন্নেসা তাদেরই একজন। শিক্ষা, দীক্ষায়, কর্মে ও সম্পদে বাঙালি জাতি উন্নত হবে। প্রতিষ্ঠিত করে নিবে বিশ্বের বুকে আপন মর্যাদার আসন, এটাই ছিল ফয়জুন্নেসার আজীবনের সাধনা।
ফয়জুন্নেসা তার চিন্তা কাজ কর্মে ছিলেন সে সময়ের চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক। সেকালের সমাজ ব্যবস্থার সবরকম বাঁধা পেরিয়ে তিনি সম্পূর্ণ কুসংস্কার মুক্ত সমাজ গঠনে মনযোগ দিয়েছিলেন। রক্ষণশীল সমাজের অন্তঃপুরবাসিনী এই নারী নিজের চেষ্টায় জ্ঞান অর্জন করেছিলেন তেমনি নিজেকে বিদ্বৎ সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। শিক্ষা, সমাজ-কল্যাণ ও সেবায় তিনি যে উদাহরণ রেখে গেছেন তার তুলনা হয় না। নিভৃত পল্লীতে বসবাস করে সমাজের অহমিকা ও দাম্ভিকতার বিপরীতে থেকে, সম্পূর্ণ নিজস্ব মেধামননকে জাগ্রত করে সেই সময়কার সামাজিক প্রতিকূল অবস্থাকে উপেক্ষা করে, নারীদের জ্ঞানকে আলোয় উদ্ভাসিত করার জন্য অক্লান্ত প্রচেষ্টা করে গেছেন তিনি।
যে যুগে মুসলিম ছেলেরাই ইংরেজি স্কুলে লেখাপড়া করত না, অথচ সে সময়ে তিনি মেয়েদের ইংরেজি শিক্ষার জন্য ১৮৭৩ সালে কুমিল্লা জেলা শহরের উপকণ্ঠে বাদুরতলায় ফয়জুন্নেসা উচ্চ ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে অসীম সাহসিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। জমিদারি পরিচালনার উপরও প্রশিক্ষন নিয়েছিলেন ফয়জুন্নেসা। বুদ্ধির দীপ্ততা, বিচক্ষণতা আর কর্মদক্ষতায় তিনি অন্য ভাইবোনদের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে ছিলেন। তার বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি পশ্চিমগাঁও-এর জমিদারি লাভ করেন। (নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর বাবার মৃত্যু সাল নিয়ে রয়েছে ভিন্ন কিছু। বাংলাপিডিয়ায় লেখা নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর বাবার আহমেদ আলী চৌধুরীর মৃত্যু হয় ১৮৮৩ সালে। ইউকিপিডিয়ায় লেখা ১৮৭৩ সালে। বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকা ও নয়াদিগন্ত পত্রিকায় লেখা ১৮৪৪ সালে। তবে নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর মা আরাফান্নেসা চৌধুরাণীর মৃত্যু সাল ১৮৮৫, তা ঠিকই আছে। আবার অনেক লেখায় বাবা আহমেদ আলী চৌধুরীর মৃত্যু সাল লেখা নেই।)
১৮৮৫ সালে মায়ের মৃত্যুর পর তিনি মাতুল সম্পত্তিরও উত্তরাধিকারী হন। মায়ের মৃত্যুর পর ফয়জুন্নেছা জমিদারীর দায়িত্ব কর্মতৎপরতার মাধ্যমে নিজেকে গড়ে তুলেন একজন সুদক্ষ, প্রজাহিতৈষী, শিক্ষানুরাগী, তেজস্বী ও বিচক্ষণ শাসক হিসাবে। তিনি পিতা-মাতার শোককে হাতিয়ার করেই দীর্ঘ ২১ বছর জমিদারী শাসনে হয়ে উঠেন জীব সংগ্রামের এক অনন্যা মহিয়ষী নারী। নওয়াব ফয়জুন্নেসা আমরণ সিংহচিহ্ন অঙ্কিত জমিদারির চেয়ার পরিত্যাগ করে সামান্য বেতের নির্মিত মোড়ায় উপবিষ্ট হয়ে একজন প্রজাদরদি সুযোগ্য শাসকরূপে ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। ১৮৮৯ সালে হঠাৎ করে ফয়জুন্নেছার স্বামী ব্যাথা যন্ত্রনা নিয়ে কুমিল্লা শহরের নিজ বাড়ীতে মৃত্য বরন করেন। কুমিল্লা সৈয়দ বাড়ীর পারিবারীক কবর স্থানে তাকে সাহিত করা হয়। উল্লেখ আছে বিচ্ছেদের পর থেকে স্বামীর মৃত্যু পর্যন্ত কারো সাথে কারো দেখা সাক্ষাৎ হয়নি।
ফয়জুন্নেসা সঙ্গীতানুরাগিনী ছিলেন,নিজে গানও লিখতেন। তাঁর লেখা কাব্যে বার মাসি, সহেলা, বিরহ বিলাপ, খেদোক্তি ইত্যাদি শিরোনামে যে সব পদ্য আছে সে গুলোও সঙ্গীত’। সঙ্গীত সম্পর্কিত তাঁর স্বতন্ত্র গ্রন্থও আছে। সে সময়ে বনেদি মুসলিম পরিবারের একজন মহিলার জন্য এটিও একটি সাহসী পদক্ষেপ। বৃটিশ অপশাসনের ফলে মুসলিম সমাজে কুসংস্কারের বেড়াজালে অবরোধবাসিনী হয়েও ফয়জুন্নেসা সাহিত্য সাধনার মাধ্যমে একটি গৌরবময় স্থান অধিকার করে আছেন। নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর সঙ্গে সংস্কৃত সাহিত্যের গভীর সম্পর্ক ছিল। বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সাময়িকীর পৃষ্ঠপোষকতা করেন। বান্ধব, ঢাকা প্রকাশ, মুসলমান বন্ধু, সুধাকর, ইসলাম প্রচারক প্রভৃত বাংলা পত্রপত্রিকা তাঁর আর্থিক সহায়তা করেন। কেবল সমাজসেবায় নয়, তিনি সাহিত্য সাধনায়ও অনন্য অবদান রেখেছিলেন তার উদাহরণ 'রূপজালাল' কাব্যগ্রন্থ।
নবাব ফয়জুন্নেসা এমন এক সময়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা করেন যখন অভিজাত মুসলমানদের মধ্যে এই ভাষা সাধারণত ব্যবহূত হতো না। গদ্যে-পদ্যে রচিত তাঁর "রূপজালাল" রূপকের আশ্রয়ে লেখা একটি আত্মজীবনীমূলক রচনা। এতে তাঁর বিড়ম্বিত দাম্পত্য জীবনের করুণ কাহিনী স্থান পেয়েছে। ১৮৭৬ খ্রীস্টাব্দে ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা গিরিশচন্দ্র মুদ্রণ যন্ত্র থেকে শ্রীমতি নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণী রচিত সাহিত্য গ্রন্থ ‘রূপজালাল' প্রকাশিত হয়। বইটির মূল্য ছিল দেড় টাকা, আর গ্রন্থের পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ৪১৭। 'রূপজালাল' গ্রন্থটি মধ্যযুগের কবি আলাওলের রচনার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল। তার সাহিত্য সাধনার খুব অল্প সময়ে তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের সমসাময়িক লেখক। শুধু তাই নয় প্রথম মুসলিম গদ্য-পদ্যে লেখিকা ছিলেন তিনিই।
সাহিত্য সাধনায় তার কৃতিত্ব তাকে পার্থিব জীবনে এনে দিয়েছে সুউচ্চ সম্মান। এছাড়া 'সঙ্গীতসার' ও 'সঙ্গীতলহরী' নামে তাঁর দুখানি কাব্যের কথাও জানা যায়।
ব্যক্তিগত জীবনের ব্যর্থতাকে সৃষ্টিকর্মে তিনি সফল হতে দেখেছেন। তিনি অন্তর্দাহ প্রকাশ করতে গিয়ে ‘রূপ জালাল’ উপন্যাস রচনায় মাঝে মাঝে কবিতার আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। ‘রূপ জালাল’ এ ফুটে উঠেছে ফয়জুন্নেসার কবি প্রতিভা। সতীন বিদ্বেষের কারণেই ফয়জুন্নেসার বিবাহিত জীবন ব্যর্থ হয়ে যায়। রূপ বানুর সতীন হুরবানু তাদের পরিণতি কিরূপ ছিল? গ্রন্থের শেষ কয়েকটি চরণে তা’ প্রকাশ পেয়েছে-
হুর বানু নিয়ে রানী, রূপবানু মনে।
মিলন করিয়া দিল প্রবোদ বচনে ॥
দোহে সম রূপবতী সম বুদ্ধিমতী।
বিভূ কৃত ভেবে দোহে জন্মিল সম্প্রীতি ॥
উভয় সপত্নী নানা গুণে গুণবতী।
আনন্দে বিহরে দোহে পতির সঙ্গতি ॥
দুইজন নিয়ে সম দৃষ্টিতে রাজন।
নিত্য সকৌতুকে কাল করয়ে যাপন ॥
সিংহাসনে বসি সদা হরিষে অন্তরে।
বিধি বিধানেতে ভূপ রাজকার্য্য করে ॥
বিচার কৌশলে দূর হৈল অবিচার।
প্রজার জন্মিল ভক্তি সুখ্যাতি প্রচার ॥
স্বামী বিচ্ছেদের প্রায় ৯ বছর পরে ‘রূপ জালাল’ প্রকাশিত হয়। গ্রন্থখানি তিনি স্বামীর নামেই উৎসর্গ করেন।
ভারতের নিভৃত পল্লীর এ বিদূষী রমণী বেঁচে থাকতে তার কাজের স্বীকৃতি সেভাবে পাননি । ১৮৮৯ সালে ইংরেজ শাসনামলেই মহারানী ভিক্টোরিয়া কর্তৃক ভারতবাসীর কর্ম-কৃতিত্বের জন্য খেতাব প্রদানের তালিকায় প্রথম বাঙালি নারী হিসেবে স্থান পেয়েছিলেন বাংলাদেশের অখ্যাত পল্লী অঞ্চলের মুসলিম নারী জমিদার ‘নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী’। শুভেচ্ছার প্রতীক হিসেবে তাকে মনোহর তারকাকৃতির হীরকখচিত একটি পদকও উপহার প্রদান করা হয়, যা তিনি স্বহস্তে গ্রহণ করেন।
জমিদার ফয়জুন্নেছার সমগ্রজীবন ছিল নিয়মতান্ত্রিক ও শৃঙ্খলার মধ্যে। জমিদারী পরিচালনা ছাড়াও তার দুটি প্রধান সাধনা ছিল আল্লাহর ইবাদত এবং সাহিত্য সাধনা। ১৮৯১ সালে ১৮ইজুন তার স্থাবর অস্থাবর সকল সম্পত্তি জনকল্যানে ওয়াকফ করে দেন। ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ সেপ্টেম্বর (১০ আশ্বিন, ১৩১৪ বঙ্গাব্দ) নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী লোকান্তরিত হন। পশ্চিমগাঁয়ে ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে মসজিদের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। তার পাশেই থাকে
নিজ কন্যা আরশাদুন্নেসার কবর।
মৃত্যুর ১০০ বছর পরে বাংলাদেশ সরকার ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীকে সমাজসেবার ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে পদক ও সম্মাননাপত্র (মরণোত্তর) প্রদান করেন। তাঁর স্মৃতিকে অমর করে রাখতে প্রতিষ্ঠা হয়েছে 'নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ফাউন্ডেশন।
লেখক- সাহিত্যিক কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক।