একজন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও আওয়ামীলীগ
০৫ জানুয়ারি ২০১৯, ১২:১২ পিএম

সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিনি পার্থিব ইহমায়া ত্যাগ করে ৩ জানুয়ারি ২০১৯ তারিখে সকলকে কাঁদিয়ে ওপাড়ে পাড়ি জমিয়েছেন। ১৯৫২ সালের ১ জানুয়ারি তিনি ময়মনসিংহ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ৬৮ বছর বয়সে তিনি অকালে প্রয়াত হলেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার যশোদল ইউনিয়নে। তাঁর পিতা বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সৈয়দ নজরুল ইসলাম, যিনি তখন ময়মনসিংহে একাধারে আনন্দমোহন কলেজের একজন শিক্ষক, আইনজীবী, ভাষা সংগ্রামী ও রাজনীতিবিদ ছিলেন।
আজ সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম শুধু একটি নাম নয়, একটি প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের নামটি সামনে এলেই চোখে ভেসে উঠে একটি হাসিমাখা মুখ, কথাবার্তায়, চলনে-বলনে ভদ্রতার এক মূর্ত প্রতীক। আর সততার প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে তাঁকে পিছনে ফেলে যাবে এমন মানুষের সংখ্যা নিতান্তই হাতে গোণা। এমন একজন মানুষের এভাবে চলে যাওয়া সত্যিই দেশের জন্য রাজনীতির অঙ্গনে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। মাত্র অল্প কিছুদিন আগেই তিনি তাঁর সহধর্মিণীকে হারিয়েছেন। তিনি এত ভালো একজন মানুষ ছিলেন যে আমি তাঁর জীবনের কোথা থেকে লিখব ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।
তিনি জন্মগতভাবেই একজন জাত রাজনীতিক ছিলেন। ছাত্রজীবনে স্বাধীনতার সময়ে তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। পরবর্তীতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিরও প্রচার সম্পাদক হয়েছিলেন তিনি। তার থেকেও বড় পরিচয় তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডির পর একই বছর ৩ নভেম্বর ঘটে জেলখানায় আরেক নারকীয় হত্যাকাÐ। সেই হত্যাকাÐে অপর তিন জাতীয় নেতা তাজউদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এএইচএম কামরুজ্জামান প্রমুখের সাথে নির্মমভাবে শহীদ হন সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
১৫ আগস্টের সময় সকল স্বজন হারিয়ে যেমন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকার কারণে বেঁচে যান এবং বিদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন, ঠিক তেমনি জেল হত্যার পর সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ইংল্যান্ডে চলে যান। সেখানে তিনি দীর্ঘদিন থেকেছেন এবং ইংল্যান্ডে বিদেশের মাটিতে বসেও আওয়ামীলীগকে সংগঠিত করেছেন নিরন্তর। ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে এসে তৎকালীন কিশোরগঞ্জ-৩ সদর (বর্তমানে কিশোরগঞ্জ-১, সদর ও হোসেনপুর) আসন থেকে আওয়ামীলীগের মনোনয়নে প্রথমবার এমপি নির্বাচিত হন। এরপর তাঁকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তাঁর গুণই তাঁকে সবসময় সামনের দিকে এগিয়ে দিয়েছে।
১৯৯৬ সালে তিনি দায়িত্ব পান বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে। পরের ইতিহাস দেশবাসীর জানা রয়েছে। ২০০১ সালের নির্বাচনেও (তখন সারাদেশে আওয়ামীলীগের মাত্র ৫৫টি আসন ছিল) এই আসন থেকে তিনি এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় মেলে দলের সবচেয়ে দুঃসময়ে। ২০০৭ সালে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা, সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবর্গ যখন জরুরি সরকার কর্তৃক বন্দী হয়ে জেলে। তখন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। সেসময় অপর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুকুল বোস যখন তথাকথিত সংস্কারপন্থীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, ঠিক তখনই বিদেশ থেকে ফিরে এসে দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দৃঢ়তার সাথে কিশোরগঞ্জের আরেক কৃতিসন্তান বর্ষিয়ান ও পরিক্ষীত আওয়ামীলীগ নেতা ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জিল্লুর রহমানকে সাথে নিয়ে দলের ঐক্য ধরে রাখতে সমর্থ হন।
তারপর ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে বিপুল জয়ের মধ্য দিয়ে ২০০৯ সালে সরকার গঠন করার পর দলের কাউন্সিলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। পরে ২০১২ সালের কাউন্সিলেও তাঁকে দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক পূণনির্বাচিত করা হয়। তিনি ২০০৯ সালে এলজিআরডি ও সমবায় মন্ত্রণালয় এবং ২০১৪ সালের দশম সংসদের পর একই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছিলেন। কিন্তু কিছুটা শারিরীক অসুস্থতার জন্য দলে ও সরকারে তেমনভাবে সময় দিতে না পারার কিছু নিন্দুকের অভিযোগে এলজিআরডি ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে থাকা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
এরপরে শারিরীক অসুস্থতার কারণে তিনি আর তৃতীয় মেয়াদে দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানানোতে বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি তখন হন আওয়ামীলীগের নীতিনির্ধারণী ফোরাম সভাপতিমÐলীর সদস্য। সরকার পরিচালনায় থাকা একটি দলের সাধারণ সম্পাদক হয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সুন্দর, সুষ্ঠু ও সফলভাবে দায়িত্ব পালন করে নির্লোভ, সৎ, সাদাসিধে জীবন যাপনের উদাহরণ খুব একটি নেই। ১৯৯৬ সালে দেশে ফেরা থেকে অদ্যাবধি তাঁর জীবনে হারার কোন ইতিহাস নেই। প্রতিটি নির্বাচনেই তিনি বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছেন। আমরা জানি জেলখানায় থেকে অনেকে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে পাশ করেছেন। কিন্তু অসুস্থ অবস্থায় বিদেশের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে সরাসরি নির্বাচনে পাশ করার ইতিহাস একেবারে খুবই কম। কারণ তাঁর মৃত্যুর মাত্র চারদিন আগে সংগঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনেও তিনি নৌকা মার্কা নিয়ে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর এবং জাতির দুর্ভাগ্য তিনি এবারে আর এমপি হিসেবে শপথ নিতে পারলেন না। বরং তাঁর সতীর্থদের শপথ গ্রহণের দিনই তাঁর মৃত্যু হল।
এমন নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিক কালেভদ্রে জন্মগ্রহণ করেন না। আমরা যতদূর দেখেছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তিনি খুব ¯েœহভাজন এবং আস্থাভাজন ছিলেন। আমরা জানি সেজন্য শেখ হাসিনা তাঁকে তাঁর হারানো ভ্রাতৃ¯েœহে ভালবাসতেন। তিনি আসলে আওয়ামীলীগের একজন কাÐারি ছিলেন। তিনি শুধু আওয়ামীলীগ দলীয় ব্যক্তিদেরই শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন না। তাঁর মৃত্যুর পর বিভিন্ন দলমত, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ তাঁকে স্মরণ করে শোকবার্তা দিয়ে চলেছেন। এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুধু সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের ছবি ছাড়া আর কিছুই যেন নেই। তাঁর নিজের এলাকা কিশোরগঞ্জে তিনি খুবই জনপ্রিয় নেতা ছিলেন।
তিনি জীবিত থাকলে দেশ, জাতি, দল, সরকার একজন ভালো মানুষ পেত। আমি আগেই বলেছি, কোনকিছু দিয়েই তাঁর গুণের কথা বলে-লিখে শেষ করা যাবে না। আর্থিকভাবে তিনি এতটাই স্বচ্ছ ছিলেন যে, সরকারের তরফ থেকে তাঁর চিকিৎসার খরচ বহনের কথা বলা হলেও তিনি সে সুযোগ না নিয়ে ঢাকায় থাকা তাঁর পৈত্রিক বাড়ি বিক্রি করে তিনি চিকিৎসার খরচ চালিয়েছেন বলে জানা গেছে। আজ এটুকুই। চলুন আমরা সবাই এ বর্ষিয়ান নেতার বিদেহী আত্মার জন্য শান্তি কামনা করি এবং দোয়া করি তিনি যেন নির্বিচারে বেহেস্তবাসী হন। সেইসাথে রাজনীতিতে যেন তাঁর অভাব পূরণ হয়। কারণ তা না হলে যে দেশের বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে।
লেখকঃ ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ^বিদ্যালয়।